'বঙ্গদেশে' প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ।
https://www.bangodesh.com/2022/03/evil-side-of-politics/
আধুনিক কালের রাজনীতি মূলতঃ দল-ভিত্তিক। ভারতীয় রাজনীতি গড়ে উঠেছে এই দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়েই। স্বাধীনতার পর ভারতে যে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ভিত্তি হচ্ছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম বা সংসদীয় ব্যবস্থা, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমের মতো নয়। ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতি মূলতঃ বহুদলীয়।
এই দলত্যাগ প্রধানতঃ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যা ভারতের বহুদলীয় রাজনীতিতে এক বিশেষ মাত্রা অর্জন করেছে। ১৯৬৭ সালে হরিয়ানার বিধায়ক গয়া লালের ধারাবাহিক দলত্যাগের ইতিহাস আজ ‘আয়া রাম গয়া রাম’ নামে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। এরপর ১৯৮৫ সালে দলত্যাগ বিরোধী আইন পাশ হয়ে সংবিধানের দশম তপশিলীতে স্থান পেয়েছে, যা আবার ২০০৩ সালে পুনঃসংশোধিত হয়েছে। কিন্তু, এতো কিছুর পরেও দলত্যাগ নিয়ে বিতর্ক থামেনি, ধোঁয়াশাও কাটেনি; বিশেষতঃ প্রিসাইডিং অফিসার বা স্পিকারের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার স্পিকারের ভূমিকা নিয়ে একই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বিজেপির টিকিটে জয়ী বিধায়ক মুকুল রায় যখন সশরীরে সবার সামনে তৃণমূল কংগ্রেসের সভায় তৃণমূল কংগ্রেস দলে যোগদান করেন, তখনই তার বিরুদ্ধে বিজেপির পক্ষ থেকে দলত্যাগ বিরোধী আইনে তার বিধায়ক পদ বাতিল করার জন্য বিধানসভার মাননীয় স্পিকারের কাছে আপিল করা হয়। তারপর কলকাতা হাইকোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে মাননীয় স্পিকার বিমান ব্যানার্জি রায় দেন যে, মুকুল রায় বিজেপি বিধায়কই আছেন- তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সপক্ষে ‘উপযুক্ত প্রমাণ’ নেই। শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, আরো কয়েকজন বিধায়কের দলত্যাগ নিয়ে এই বিধানসভায় প্রশ্ন উঠেছে।
ঠিক এখান থেকেই এক নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে এবং স্পিকারের এই রায়ের বিরুদ্ধে সাংবিধানিকভাবে বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ‘উপযুক্ত’ প্রমাণের অভাব- যথেষ্ট বিতর্কিত বিষয়, যা শুধু আইনগত নয় নৈতিকতার মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতেও সাধারণ ভোটারদের কাছে বিচার্য বিষয়।
কোনো জনপ্রতিনিধি দলত্যাগ করেছেন কি না, তার মাপকাঠি কি? যদি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দল থেকে পদত্যাগ না করে থাকেন, তবে কি কি উপায়ে তার দলত্যাগের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে? এখানেই সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সেক্ষেত্রে সেই জনপ্রতিনিধির আচরণই বিচার্য। যদি তিনি প্রকাশ্যে দল-বিরোধী কথা বলেন, অন্য দলের সমাবেশে যোগদান করেন, এমনকি পরস্পর-বিরোধী কথা-বার্তা বলতে থাকেন যা তার দলের নীতি-কার্যক্রম বিরোধী, বা পরিষদীয় কক্ষে দলীয় নীতি মেনে চলা আর বাইরে দলীয় নীতি অমান্য করা - এসবই দল-বিরোধী কার্যক্রমের আওতায় পড়ে কি না তা শুধুমাত্র প্রিসাইডিং অফিসারের বিচার্য বিষয় হতে পারে না। কারণ, ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রিসাইডিং অফিসার অর্থাৎ স্পিকার বা চেয়ারম্যান দলীয় ভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের থেকেই নির্বাচিত হন। এছাড়াও সংবিধানের ৩২, ১৩৭ এবং ২২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রিসাইডিং অফিসারের রায় হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচার্য বিষয় হতে পারে।
সেই অবস্থান থেকেই সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার স্পিকারের মুকুল রায়- সংক্রান্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে বিজেপির করা আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট কেসটি কলকাতা হাইকোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছেন ও এক মাসের মধ্যে এই কেসের নিষ্পত্তি করতে বলেছেন। কিন্তু মনে হয়, এই কেসটি শেষ পর্যন্ত আবার সুপ্রিম কোর্টেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য যাবে।
দলত্যাগ বিরোধী আইনের অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, স্পিকারের স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা বা ডিস্ক্রিশনারি পাওয়ার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সময়সীমা না থাকা। তাই শেষ পর্যন্ত কোর্টের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আদালতকে হস্তক্ষেপ করতেই হচ্ছে। এক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে।
এর ফল হচ্ছে, সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা হারানো এবং জনাদেশের প্রতি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অবমাননাকর অবস্থান। দলত্যাগ বিরোধী আইনের সংস্কার ও সংশোধনী নিয়ে অনেক প্রস্তাব পেশ হয়েছে। কিন্তু জনগণের রায়কে উপেক্ষা করা হয়েই চলেছে। এর শেষ কোথায়?
@ ড. সুজিৎ রায়
07.03.2022
No comments:
Post a Comment