'বঙ্গদেশ' পোর্টালে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ।
https://www.bangodesh.com/2022/01/india-gate-netaji-a-new-chapter/
গত ২৩শে জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীনরেন্দ্র মোদি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে দিল্লির আইকনিক ইন্ডিয়া গেটে ‘জাতির আইকন’ নেতাজির হলোগ্রাম মূর্তি উদ্ধোধন করলেন। এই মূর্তি সাময়িক; আগামী ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষের ‘অমৃত মহোৎসবে’ নেতাজির পূর্ণাবয়ব গ্রানাইট পাথরের মূর্তি স্থাপিত হবে ওই জায়গায়, যেখানে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিভূ হিসাবে রাজা পঞ্চম জর্জের মূর্তি ছিল। কি অদ্ভুত সমাপতন! মোদিজির কথায়: ‘নেতাজির এই মূর্তি আপামর ভারতবাসীর তার প্রতি ঋণ স্বীকারের প্রতীক’। ভারত সরকার গতবছরই নেতাজির জন্মদিনকে জাতির ‘পরাক্রম দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। আবার প্রধানমন্ত্রী মোদিজি ‘সুভাষচন্দ্র বসু আপদা প্রবন্ধন পুরস্কার’ ওই দিন প্রদান করলেন।
এখন প্রশ্ন: ইন্ডিয়া গেটে নেতাজির এই মূর্তি-স্থাপনার গুরুত্ব কতোটা? প্রকৃত-প্রস্তাবে নেতাজির এই মূর্তি শুধুমাত্র দেশবাসীর ঋণ-স্বীকারের প্রতীক নয়; এই মূর্তি-স্থাপনা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে ন্যারেটিভ এ যাবৎকালে গড়ে উঠেছে তার দিশার দিক-পরিবর্তনের সূচনা করছে। এ এক প্যারাডাইম শিফট। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক ধারা হিসেবে অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি যে সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের ধারা ছিল, যাকে এতদিন ধরে মেইনস্ট্রিম ইতিহাসের ন্যারেটিভে উপেক্ষা করা হয়েছে, সেই সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাকে এই মূর্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মোদি সরকার আসার পর থেকেই এই ‘অপর’ ধারাকে অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।
‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ সংহত করে নেতাজি যে ‘দিল্লি চলো’ ডাক দিয়েছিলেন, তা শুধুমাত্র ভারত থেকে ঔপনিবেশিক শাসনকে উৎখাত করার জন্যই নয়; তার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় জীবনধারায় যে ঔপনিবেশিক মানসিকতা গড়ে উঠেছে তাকেও দূর করার আহ্বান ছিল। ভারতের ধার্মিক ঐতিহ্যের পরম্পরাগত ধারাকে নেতাজি তার জীবনে গভীরভাবে বিশ্বাস ও জীবনচর্চায় নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। বর্তমান ভারত সরকার সেই ধার্মিক পরম্পরাগত ধারাকেই অনুসরণ করে ভারতীয় সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এই ভারতভূমিতে ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ এই আদর্শকে এক সুমহান সর্বোচ্চ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এই আদর্শকে কখনই চরমভাবে সকলের জন্য সমান ভাবে সব সময় প্রয়োগের জন্য মানা হয়নি। তথাপি মহাত্মা গান্ধী তার অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে এই আদর্শকেই ব্যবহার করেছিলেন। তবে ভারতীয় জীবনধারায় ধর্মকে শুধুমাত্র ধর্মমত হিসেবে ধরা হয়নি। ভারতীয়দের কাছে ধর্ম এক কর্তব্য-স্বরূপ। সেই প্রেক্ষিতে ‘সত্যাগ্রহ’ যেমন গান্ধীজীর কাছে এক ধর্মীয় কর্তব্য, ঠিক তেমনি ভাবে ‘ন্যায় যুদ্ধ’ নেতাজির কাছে এক ধর্মীয় কর্তব্য।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ধারা ছিল সশস্ত্র বৈপ্লবিক ধারা। ঠিক সেই কারণেই ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ সালের সশস্ত্র সংগ্রামকে যখন শুধুমাত্র ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ বলে ছোট করতে চেয়েছিল, তখন বীর সাভারকার সেই বিদ্রোহ ও মহাসংগ্রামকে ভারতের ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেই ধারাতেই ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করতে একের পর এক সশস্ত্র সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল, যার মূলে ছিল ন্যায় যুদ্ধের ধার্মিক ভিত্তি। নেতাজি সুভাষের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম ও যুদ্ধ ছিল ভারতবর্ষের সেই ‘ধর্মযুদ্ধের’ ঐতিহ্যবাহী, যেখানে ভারতমাতার সন্তানেরা মাকে শৃঙ্খল মুক্ত করতে অসমসাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
‘সাইক্লোনিক হিন্দু সন্ন্যাসী’ স্বামী বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ ভাবশিষ্য হিসাবেই নেতাজি সুভাষ অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ন্যায় যুদ্ধের উপায় হিসাবে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। ভারতবাসীর ‘স্বরাজ’এর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে রাজনৈতিক বাস্তববোধের ভিত্তিতে নেতাজি প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ‘কৌটিল্য-নীতি’ অনুসরণ করেছিলেন: ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’! কারণ, ব্যক্তিগত আদর্শ তথা ভালো-মন্দ নয়; বরং ভারতমাতার শৃঙ্খল-মোচনের জন্য তার কাছে একটাই ‘ইজম’ ছিল, তা হল ন্যাশনালিজম ও জাতীয় স্বার্থ।
সেই জাতীয়তাবোধ তথা জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষাপটেই ভারত সরকার ইন্ডিয়া গেটে ভারতমাতার পরাক্রমী সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি স্থাপন করছে, যাতে ভারতবাসীর ‘সামূহিক স্মৃতি’তে ভারতবর্ষের সশস্ত্র সংগ্রামের ধার্মিক পরম্পরার ঐতিহ্য চির জাগ্রত থাকে এবং জাতীয় জীবনে সেই ধারার প্রকৃত মূল্যায়ন হয়।
@ ড. সুজিৎ রায়
26.01.2022
Savarkar আর নেতাজি র নাম একসাথে
ReplyDeleteউচ্চারণ না করাই ভালো