Here is the link of eBook of my book on research studies titled "Research: Structure, Process and Behaviour".
Regards,
Dr. Sujit Roy
Research Analyst. Author. Columnist.
Here is the link of eBook of my book on research studies titled "Research: Structure, Process and Behaviour".
Regards,
Dr. Sujit Roy
আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'মানুষ বড়ো একলা' ই-বুক
প্রকাশিত হলো। নীচে লিঙ্ক:
সবাই ভালো থাকুন।
ড. সুজিৎ রায়
Ebook of my PhD Thesis "Emerging Horizons For Women Entrepreneurship: A Sociological Enquiry" is now in public domain after ten years.
Herein below the link.
https://drive.google.com/file/d/1VNRyDg371lxuk-AqW9XYOg1fkcpWwff2/view?usp=drivesdk
Thanks and regards,
Dr. Sujit Roy
10.08.23
"ভারতীয় সভ্যতার সমস্যাগুলোর মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থাই সবথেকে দুঃখজনক"
এম নাগেশ্বর রাও
'নিজের ধর্ম ও ভাষা জানা এক ব্যক্তিই অপরকে সম্মান দিতে জানে, যা সমাজে সংহতি ও একতা আনতে পারে'
১৯৫০, ২৬ জানুয়ারিতে যখন আমাদের সংবিধান কার্যকরী হলো, তখন সেই সংবিধানে শব্দসংখ্যা ছিল ৮০ হাজার। আশ্চর্যজনকভাবে, তখন ২৫ নং অনুচ্ছেদে ভাব উল্লেখ ছাড়া 'সেক্যুলার' শব্দটি অনুপস্থিত ছিল। তাই, ১ নং অনুচ্ছেদ এবং ২৫ থেকে ৩০ নং পর্যন্ত অনুচ্ছেদগুলি একসঙ্গে, যা মূল সংবিধানের ভূষণস্বরূপ, আমাদের দেশের ধর্মীয় চরিত্রকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের সংবিধান সকল ধর্মমতকে স্বীকৃতি তথা মর্যাদা দিয়েছে।
অবশ্য, আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষা-ব্যবস্থা আমাদেরকে ধর্মবোধহীন এবং ঐতিহ্য-বিহীন করে আত্মদোষ-পরায়ণ ব্যক্তি হিসাবে গড়ে তুলছে। এর সঙ্গে আছে বিভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থার, বিশেষতঃ ২৮ নং অনুচ্ছেদের ক্ষতিকর প্রভাব, যা হিন্দুদের উপরেই বেশি করে পড়েছে; কিন্তু, ৩০ নং অনুচ্ছেদ সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-বিযুক্ততার বিপদ থেকে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সব নাগরিককেই রক্ষা করার জন্য লোকসভায় ১৯৯৫ সালে সৈয়দ শাহাবুদ্দিন ৩৬ নং প্রাইভেট মেম্বারস বিল উত্থাপন করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ৩০ নং অনুচ্ছেদের পরিসর বাড়ানো। সেই বিলে ওনার অপ্রতিরোধ্য যুক্তি ছিল: "সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু সব ধরনের গোষ্ঠীমানুষেরই ন্যায্য অধিকার আছে, তাদের পরম্পরাগত ঐতিহ্য ও ভাষাকে রক্ষা করে পরবর্তী প্রজন্মকে সেই ভাবধারায় পরিশীলিত করার।"
শ্রদ্ধেয় ধর্মপালজী তার বিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থ "দি বিউটিফুল ট্রি: ইন্ডিজিনাস ইন্ডিয়ান এডুকেশন ইন দি এইটিনথ্ সেঞ্চুরি", যা ব্রিটিশ আধিকারিকদের বিভিন্ন প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল, তাতে দেখিয়েছেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বেই নিম্ন জাতির মানুষসহ সকল জাতির মানুষের জন্য এক ধরনের কার্যকারী শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল। তিনি বলেছেন, "পাঠশালা ও মাদ্রাসাগুলি স্থানীয়স্তরে তো বটেই, এমনকি সমাজের উচ্চ স্তরেও, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মর্যাদাসহ ভারতীয়দের যথাযথভাবে অংশগ্রহণের উপযুক্ত করে গড়ে তুলত।"
আমরা সবাই জানি, মাত্র ২০০ বছরের কম সময়ের মধ্যেই ব্রিটিশরা এমনভাবে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছিল যার ফলে ১৭০০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে আমাদের অংশীদারিত্ব ২৪.৪ শতাংশ থেকে ১৯৫০ সালে তা নেমে এলো মাত্র ৪.২ শতাংশে, এবং বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদনে ১৭৫০ সালের ২৫ শতাংশ থেকে নেমে দাঁড়ালো ১৯০০ সালে মাত্র ২ শতাংশে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এতো কম সময়ে ব্রিটিশরা কিভাবে এমন ভয়াবহভাবে ভারতের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারল? তার উত্তর খুবই সহজ! তারা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে, যা পরম্পরাগত ও বৃত্তিমূলকভাবে সংপৃক্ত ছিল, তার পুরোপুরি মূলোৎপাটন করেছিল এবং ভারতকে বিশ্বের অন্যতম গরিব দেশে পরিণত করেছিল।
মহাত্মা গান্ধী তার অননুকরণীয় ভঙ্গিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য ব্রিটিশকে দায়ী করে বলেছিলেন, "তারা মাটি খুঁড়ে গাছের মূলকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ও তাকে সেরকমই রেখে দিয়েছিল, এবং ফলে সেই সুন্দর গাছটি মরে গেল।" তথাপি, স্বাধীনোত্তরকালে আমরা তার থেকে কোনো শিক্ষা নিলাম না যে, সভ্যতার ঐতিহ্য সম্পৃক্ত থাকা শিক্ষাব্যবস্থাই স্থায়ী সমৃদ্ধির প্রাথমিক শর্ত।
গবেষণামূলক ভাবে এটা বলা যায়, কঠোর পরিশ্রম ও উদ্যোগী মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ থাকলেও কোনো দেশ, যদি তার সভ্যতার পরম্পরার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকে, তা কখনোই টেকসই সমৃদ্ধশালী হয়ে উড়তে পারে না। ইউরোপ তার খ্রিস্টীয় সভ্যতার দ্বারাই সমৃদ্ধির দিকে চালিত হয়েছিল এবং তার সাম্প্রতিক অবনতির জন্য দায়ী হলো সভ্যতার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত খ্রিষ্টীয় রক্ষণশীলতার দেশ। জাপান গভীরভাবে ঐতিহ্যবাহী দেশ, যা তাকে পারমানবিক আক্রমণের জন্য ধ্বংস হওয়ার পরেও পুনরুত্থানের পথে সাহায্য করেছে। ভূতপূর্ব সুপার পাওয়ার কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়া, যা তার নিজস্ব ইস্টার্ন অর্থোডক্সির পরম্পরাকে ধ্বংস করেছিল, তা মাত্র ৭০ বছরের মধ্যেই নিজেই ধ্বংস হয়ে গেল। তাই, সভ্যতার পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তাকে বুঝে আজকের কমিউনিস্ট চিন তার মান্দারিন ভাষা ও কনফুসিয়বাদকে তুলে ধরার উপর জোর দিচ্ছে।
কিন্তু, ভারত এখনো বিভ্রান্ত। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যেন 'না এখানে, না ওখানে'! আমরা আমাদের সভ্যতার সমস্ত ধরনের পরম্পরাগত জ্ঞান-বিদ্যাকে নির্বাসিত করেছি এবং 'ঋকবেদ', যা পৃথিবীর প্রাচীনতম শাস্ত্রীয় জ্ঞান, তা-সহ সমস্ত প্রাচীন টেক্সট আমরা পরিত্যাগ করেছি। আমরা অভাবনীয় সমৃদ্ধ ভাষিক ঐতিহ্য ও অসংখ্য ভাষাকে পরিহার করে ইংরেজিকে তুলে ধরেছি। ভারতীয় ঐতিহ্যের মূলসূত্রহীন আজকের শিক্ষা নীতিগুলি মূলতঃ ব্রিটিশদের মেকলীয় নীতিরই ধারাবাহিকতা। তার জন্য, আনন্দ কেনটিশ কুমারস্বামীকে উদ্ধৃত করে বলা যায়, "ভারতের সকল সমস্যার মধ্যে সবথেকে জটিল ও দুঃখজনক সমস্যা হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা।" আমার নিজের এক আত্মীয়, যিনি আমেরিকায় থাকেন, একবার বলেছিলেন, তিনি যতবার ভারতে আসেন ততোবারই যেন বেশি করে পশ্চিমকে ভারতে দেখতে পান।
এটা সত্য যে, সংবিধানের ২৮ নং অনুচ্ছেদ সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষাদান নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু, আমাদের পরম্পরাগত জ্ঞান-বিদ্যা ও প্রাচীন গ্রন্থসমূহ শিক্ষা এবং ধর্মীয় রীতির পরিবর্তে তুলনামূলক ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে সংবিধান নিষেধ করেনি। তাছাড়াও, সংবিধান সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসহ সমস্ত সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু অসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষাকে ব্রাত্য করেনি। তথাপি, আমরা নিজেরাই তা ব্রাত্য করেছি এবং পরিবর্তে, যা কিছু বিদেশি তাই আমরা শিখেছি। স্বাধীনোত্তর কালে আমাদের প্রাচীন সভ্যতাকে জাতীয়ভাবে উপেক্ষা করাকে অনেকটা তুলনা করা যায় যখন কোন একজন নতুন 'ধর্মান্তরিত' ব্যক্তি তার পুরনো পাগান অতীতকে যেভাবে প্রতিহিংসামূলক ভাবে অস্বীকার করে!
পুরুষানুক্রমিক ভাবে আমরা তিন ধরনের ঋণ- দেবঋণ, ঋষিঋণ ও পিতৃঋণ, যাদের কাছে পরম্পরাগত জ্ঞানের জন্য আমরা সভ্যতাগত ভাবে ঋণী, তা স্বীকার করতে আমরা দায়বদ্ধ। তার অর্থই হলো, পরম্পরাগত ভাবে আমরা যা পেয়েছি, সেগুলিকে অবিকৃতভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এই পরম্পরাকে ধ্বংস করার কোন অধিকার আমাদের নেই; কারণ, সেগুলোকে আমরা তৈরি করিনি। অতএব, আমরা অবশ্যই পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের সভ্যতাগত জ্ঞান শিক্ষা দেব এবং দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষার মূলসূত্রগুলি বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা দেব।
ভারত বহুভাষী এক দেশ এবং হাজার হাজার বছর ধরেই ভারতীয়রা বহুভাষী বা বহুভাষার পরিবেশে বাসরত। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের আগে, আজকের রাজ্য-সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষেরা দুই ভাষাই জানত। ১৯৫৬ সালের পরবর্তীতে, দুই প্রতিবেশী রাজ্যের বাসিন্দাদের মধ্যে গড়ে ওঠা ভাষাভিত্তিক দেওয়ালকে আমাদের অতিক্রম করতে হবে। এছাড়া, উর্দু বাদে বাকি অন্যান্য ভারতীয় ভাষাগুলি ইংরেজির দাপটে ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। ভারতীয় ভাষাগুলি মৃত হলে ভারতীয় সভ্যতাও বাঁচতে পারবে না। কারণ, আমাদের ভাষা ও সভ্যতা একই মুদ্রার দুই পিঠ।
অতএব, সংবিধানের ৩৫০এ অনুচ্ছেদ ও আরটিই এ্যাক্টের ২৯ সেকশন অনুযায়ী দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষাকে পড়াশোনার মাধ্যম করতে হবে। যারা দশম বা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষাতে পড়াশোনা করেছে, তাদেরকে সিভিল সার্ভিসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়াসহ বিভিন্ন বৃত্তি, সুদ-বিহীন শিক্ষাঋণ ইত্যাদি সুবিধা দিতে হবে।
এছাড়াও, বহুভাষিকতাকে শক্তিশালী করতে মাতৃভাষা ছাড়াও সকল ছাত্রকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অন্তত অন্য একটি ভারতীয় ভাষাকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে হবে। অবশ্য, ছাত্রদের পার্শ্ববর্তী রাজ্যের ভাষাসহ সংস্কৃত, হিন্দি ইত্যাদি ভাষা থেকে যে কোনো একটা ভাষাকে পছন্দ করার সুযোগ দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, তামিলনাড়ুর ছাত্রদের তেলেগু, কন্নড়, মালায়ালাম, সংস্কৃত ও হিন্দি থেকে যে কোনো একটি ভাষাকে পছন্দ করার সুযোগ দিতে হবে।
আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতাই হল আমাদের পরিচিতি-সত্তা। এই সত্তা হারানো মানে সবকিছুই হারিয়ে ফেলা। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, ধার করা পরিচিতি দিয়ে সমৃদ্ধি আসতে পারে না। এটাও সত্য যে, একজন শিল্পীই অন্য একজন শিল্পীর কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন। সেই ভাবেই, একজন ব্যক্তি যিনি নিজের ধর্ম ও ভাষাকে জানেন তিনি অপরের ধর্ম ও ভাষাকে সম্মান দিতে পারেন, এবং সেটাই শুধুমাত্র একটা দেশের ঐক্য, সংহতি ও সমৃদ্ধি আনতে পারে।
মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন ড. সুজিৎ রায়।
The Hoax Called Vasudhaiva Kutumbakam-1: Hitopadesha
By Sarvesh K Tiwan
‘বসুধৈব কুটুম্বকম’: ছলনার আরেক নাম -১ : হিতোপদেশ
-সর্বেশ কে তিওয়ান
তিন পর্বের এক অসাধারণ ক্রিটিক্যাল নিবন্ধ, যা আমি অনুবাদ করেছিলাম এবং 'বঙ্গদেশ' ই-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এখন একসঙ্গে নিজের ব্লগে প্রকাশ করলাম।
প্রথম পর্ব
“অয়ং নিজঃ পরোবেতি গণনা লঘুচেতসাম। উদার চরিতানাম তু বসুধৈব কুটুম্বকম।।“
- “এটা আমার, ওটা অন্যের - এই ভাব শুধু এক ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী মানুষের। এক উদার চেতনা সম্পন্ন মানুষ এই পৃথিবীর সবাইকে একই পরিবারভুক্ত ভাবে।“
বর্তমানে সংস্কৃত শাস্ত্রের বিভিন্ন শ্লোকের ওপর যদি সমীক্ষা করা যায়, তবে দেখা যাবে উপরের শ্লোকটি সবথেকে বেশি উক্ত হয়েছে। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ আজকের হিন্দুদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় শ্লোকাংশ। অবশ্য এখন এই শ্লোকটি সেকুলারবাদীদের কাছে প্রায় ফেটিশের পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং শ্লোগানসর্বস্ব হয়ে উঠেছে। এই শ্লোকটি এখন আপাতদৃষ্টিতে তাদের কাছে বহুত্ববাদ বা মাল্টিকালচারালিজম এবং সর্বজনীনতাবাদ বা ইউনিভার্সালিজমের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারাকে ছোট, ক্ষুদ্র মানসিকতা হিসেবে প্রতিপন্ন করার অস্ত্র হয়ে উঠেছে। ফলে, যারা এমনিতে সংস্কৃত ভাষাকে হেয় গন্য করেন, তারা সুযোগ মত এই শ্লোকটি ব্যবহার করেন।
এখন কয়েকটি ক্ষেত্রে এই শ্লোকের ব্যবহার কি রকম হয়েছে, দেখা যাক:
১) ব্রাসেলসসে ২০০৬ সালের ১১ নভেম্বর বেলজিয়াম সরকার দ্বারা প্রদত্ত পুরস্কার ‘গ্র্যান্ড অফিসার অফ দি অর্ডার অফ লিওপোল্ড’ গ্রহণ করার সময় শ্রীমতি সোনিয়া গান্ধী তার প্রদত্ত ‘কনস্ট্রাক্টিভ ন্যাশনালিজম এন্ড এফর্টস টু ফস্টার এ মাল্টিকালচারাল, টল্যারেন্ট সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া’ ভাষণপত্রে বললেন – “প্রায় ২০০০ বছর আগে ভারত ঘোষণা করেছিল, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ – ‘সারা পৃথিবী এক পরিবার’ “; এবং
২) নতুন দিল্লিতে ২০০৬ সালের ২৫ মার্চ ‘হার্ভার্ড আলুমনি অ্যাসোসিয়েশনে’ প্রদত্ত ভাষণে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং বলেছিলেন, “প্রাচীন ভারতে উদারবাদী ভাবধারা প্রতীয়মান হয়েছিল এই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ ধারণা দ্বারা, যা ‘সভ্যতার সংঘর্ষ তত্ত্ব’ (ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন)-এর বিপরীত” … আমি এই সংঘর্ষ তত্ত্বের বিরোধী। আমাদের সেই উদারবাদী ভাবধারাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।“
স্যামুয়েল হাটিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষ তত্ত্বের বিপরীতে যে বসুধৈব কুটুম্বকম তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে - উভয় তত্ত্বই গভীর ব্যঞ্জনাময়। সংস্কৃত শ্লোকটিকে তথাকথিত উদারবাদীরা ব্যবহার করছেন নেহরুবাদী উদার আন্তর্জাতিকতাবাদকে প্রাচীন ভারতের হিন্দু ভাবধারার অনুসারী হিসেবে, যাতে হিন্দু ঐতিহ্য দ্বারা তাদের ভাবাদর্শ বা আইডিওলজিকে মান্যতা ও বৈধতা দেয়া যায় এবং প্রাচীন ভারতের উদার ভাবধারার প্রকৃত উত্তরাধিকার হিসেবে তাদের তথাকথিত উদার ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
যদি এই শ্লোকের জনপ্রিয়তাকে ভাষণের আলংকারিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো, তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। কিম্তু, উদ্দেশ্য যে আরো গভীর তার উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে ২০০৭ সালে ৫ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রদত্ত ভাষণে, যখন তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করলেন: “আমাদের বৈদেশিক নীতির ভিত্তি স্বরূপ হচ্ছে বসুধৈব কুটুম্বকম”।
সত্যিই স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি স্বরূপ হিসেবে এই শ্লোকটি বিবেচিত হয়ে আসছে। তাই ভারতের সংসদ ভবনের দেয়ালেও প্রতীক অর্থে এই শ্লোকটি গ্রথিত হয়েছে।
এই ধারাবাহিক প্রদর্শনের ফলস্বরূপ, সাধারণ হিন্দুরাও এই লোকটিকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছেন। তারাও এই শ্লোকটিকে প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের গৃহীত সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বনীতির প্রমাণ হিসেবে মেনে নিয়েছে। শুধুমাত্র হিন্দুত্ববাদীরাই নন, বিভিন্ন ধর্মীয় নেতারাও তাদের ভাষণে, লেখালেখিতে এই শ্লোকটিকে ব্যবহার করে চলেছেন।
কিন্তু, আধুনিক গণসমাজের ডিসকোর্সে এই বহুচর্চিত শ্লোকটির ব্যবহার হয়ে চলেছে একটা অগভীর, এমন কি বিকৃত ধারণা থেকে। যদি আমরা শ্লোকটির উৎস তথা প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব, এক অপরিসীম অজ্ঞতা ও ভুল ব্যাখ্যা থেকে এই শ্লোকের অর্থ, ব্যঞ্জনা তথা নীতি হিসেবে এর ব্যবহার হয়ে চলেছে।
এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, আমরা ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকের উৎস, তার প্রেক্ষিত এবং নিহিতার্থ অনুধাবন করতে চেষ্টা করব, যা প্রাচীন ঋষিরা বলতে চেয়েছেন।
জনপ্রিয় ধারনা তথা মিথের বিপরীতে বলতে হচ্ছে, এই শ্লোকটি কিন্তু ঋগ্বেদ, বা মহাভারত, বা মনুস্মৃতি, এমন কি পুরাণগুলিতেও নেই। বরঞ্চ, এখনো পর্যন্ত আমরা এই শ্লোকটিকে পাই হিতোপদেশ, পঞ্চতন্ত্র, চাণক্যের সংগ্রহগ্রন্থ, ভর্তহরি, মহাউপনিষদম, বিক্রম-চরিতের কিছু সংগ্রহগ্রন্থ এবং শেষে প্রখ্যাত কাশ্মীরি কবি ভট্ট উদভাতর লেখাতে। এছাড়াও ভবিষ্যতে হয়তো অনেক গ্রন্থে এই শ্লোকটিকে পাওয়া যেতে পারে। তবে এই নিবন্ধে উল্লিখিত টেক্সটগুলি ব্যবহার করেই এই শ্লোকের প্রেক্ষিত নির্ণয় করার চেষ্টা করা হবে।
হিতোপদেশে বসুধৈব কুটুম্বকম
প্রখ্যাত কবি মহাদেবী ভার্মার আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘আমার পরিবার’এর মুখবন্ধ পড়তে গিয়ে আমি প্রথম এই শ্লোকটির সঙ্গে পরিচিত হই, যা হিতোপদেশের গল্পকথার সংকলন থেকে আহৃত হয়েছে। আধুনিক হিন্দি কাব্যজগতের প্রথিতযশা মহিলা কবি মহাদেবী ভার্মা একজন প্রকৃত পশুপ্রেমী ছিলেন এবং তার বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের পশু পাখির আবাস ছিল, যাদের তিনি তার পরিবারের অংশ হিসেবেই ধরতেন। ওই মুখবন্ধে তিনি এই পশুপাখির পরিবারকে ‘পঞ্চতন্ত্রের উল্লেখিত পশুপাখির এক পরিবার’ হিসেবেই বর্ণনা করেছিলেন। যদিও কবি সম্ভবত হিতোপদেশের কথাই বলতে চেয়েছেন, যা ‘বসুদেব কুটুম্বকম’ শ্লোকের উৎস।
ফ্রেডরিচ ফ্রয়বেল প্রস্তাবিত কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনোদনের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষাদানের প্রস্তাবের বহু শতাব্দীর আগেই এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ভারতে গড়ে উঠেছিল। যদি চিত্তাকর্ষক ও স্মরণযোগ্য গল্পকথার মাধ্যমে শিক্ষা নীতি ও উপদেশগুলিকে অর্থবহ ও উপযুক্ত ভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপনা একটি উদ্ভাবন হিসেবে গণ্য করা যায়, তবে এই শিক্ষা পদ্ধতিকে অবশ্যই প্রাচীন হিন্দুদের একটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হিসেবেই ধরতে হবে এবং হিতোপদেশকে এই পদ্ধতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরতে হবে। এই হিতোপদেশকে সাধারণাব্দীয় পঞ্চম শতকে সম্ভবত মগজ বা বঙ্গদেশে নারায়ণ পন্ডিত সংকলন করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল দুই অমনোযোগী, দুরন্ত রাজপুত্রকে সাধারণ বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গিয়ে উপযুক্তভাবে শিক্ষিত করা।
হিতোপদেশ চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত, যাতে সব গল্পকথাই যেন একটি মধ্যে আরেকটি, তারমধ্যে আরেকটি, এইভাবে শেষে যেন প্রথম গল্পকথা বা কথামুখে ফিরে যাওয়া - সবই একই বৃত্তাকার সূত্রে গাঁথা। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ একমাত্র একবারই প্রথম অধ্যায় ‘মিত্রলাভ’ অধ্যায়ে পাওয়া যায়। হিরণ্যক নামের এক ইঁদুর একটি গল্প বলে তার বন্ধু লঘুপাতনক নামের কাককে, যে গল্পটি হচ্ছে অন্য একটি কাক, এক হরিণ ও ক্ষুদ্রবুদ্ধি নামের এক শেয়ালের সম্পর্কে। এই গল্পেই ক্ষুদ্রবুদ্ধি শেয়াল এই বিখ্যাত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি বলে, যা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, যখন সেই কাকের কাছ থেকে অন্য একটি গল্প শোনে, যার শিরোনাম ‘জরদগব শকুন ও দীর্ঘকর্ণ বেড়াল’।
এইভাবে ত্রিস্তরীয় আখ্যানের মাধ্যমে রাজনীতি-প্রাজ্ঞ নারায়ণ পন্ডিত তার ছাত্রদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। সেই জন্য ঐ বিখ্যাত শ্লোকের প্রেক্ষিত বুঝতে গেলে ঐ দুটি গল্প বুঝতে হবে। একটি হচ্ছে সেই গল্প যেখানে শ্লোকটি উল্লেখিত হয়েছে, অন্যটি হচ্ছে সেই শ্লোকের সাপেক্ষে যা বলা হয়েছে। সংক্ষেপে সেই দুটি আখ্যান বলা হচ্ছে।
সুবুদ্ধি কাক, চিত্রাঙ্গ হরিণ এবং ক্ষুদ্রবুদ্ধি শেয়াল
বহু বহুদিন আগে মগধের চম্পকবতী অরণ্যে দুই বন্ধু - চিত্রাঙ্গ নামের এক হরিণ ও সুবুদ্ধি নামের এক কাক বাস করত। একদিন ক্ষুদ্রবুদ্ধি নামের এক শেয়ালের (যাকে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটির প্রস্তাবক হিসেবে পরে দেখা যাবে) যেতে যেতে সুপুষ্ট চিত্রাঙ্গ হরিণের উপর নজর পড়ল। কিম্তু সে জানতো যে, হরিণ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পালাতে পারে। তাই সেই শেয়াল হরিণের আস্থা পেতে এক ফন্দি আঁটলো। শেয়াল প্রথমেই নমস্কার জানালো এবং নতুন আগুন্তুক হিসেবে নিজেকে একা, অসহায় হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলো এবং শেষে হরিণের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে পারল। সরল সাদাসিধে হরিণ শেয়ালের মিষ্ট ভাষণে ভুল করল এবং তার নিজের আস্তানায় শেয়ালকে নিয়ে চলল, বুঝলোই না শেয়ালের প্রকৃত উদ্দেশ্য। হরিণের বাসায় যেতে যেতে পথে দেখা হলো হরিণের পুরনো ও প্রাজ্ঞ বন্ধু সুবুদ্ধি কাকের সঙ্গে। কাক হরিণকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওহে চিত্রাঙ্গ, তোমার সঙ্গে উনি কে?’ হরিণ উত্তর দিল, ‘আমার নতুন বন্ধু এই শেয়াল’। শুনে কাক জিজ্ঞাসা করল, ‘কিম্তু, তুমি কি ওকে ভালো করে জানো? ভালো করে না জেনেশুনে কাউকে বন্ধু ভাবা ও তাকে আশ্রয় দেওয়া উচিত না’। ঈষৎ কাঁধ নাড়িয়ে হরিণ উত্তর দিল, ‘এই শেয়াল ভায়া খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের’।
বন্ধুর এই অবিমৃষ্যকারিতা দেখে সুবুদ্ধি কাক হরিণকে জরদগব শকুনের গল্প বলা শুরু করলো, যে শকুন মারা গিয়েছিল ভুল করে বিশ্বাস করা এক ভন্ডের জন্য। এইভাবে কাক হরিণকেও সতর্ক করল শেয়ালের ব্যাপারে।
এ পর্যন্ত শেয়ালটি চুপচাপ সব কিছু শুনছিল। এবার সে মুখ খুলল তার যুক্তিজাল নিয়ে। বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি আওড়ে সে হরিণকে বোঝালো যে, হরিণ যেন ক্ষুদ্রমনা হয়ে কাককেই শুধু বন্ধু ভাবে, আর তাকে বিদেশি অচেনা লোক ভাবে। শঠ, চতুর শেয়াল এই শ্লোকটি ব্যবহার করে হরিণের মন জয় করে নিলো ও তার আস্তানায় চলল।
তাই, গল্পটির সারমর্ম দু’লাইনে বলা যায়। ধূর্ত শেয়াল এইভাবে সরল হরিণের সঙ্গে থাকতে আরম্ভ করল এবং এক সময় সুযোগ বুঝে হরিণকে ফাঁদে ফেলল। অবশ্য হরিণকে মেরে ফেলার আগেই সুবুদ্ধি কাক এক চতুর উপায়ে হরিণকে শুধু বাঁচালোই না, ওই শেয়ালেরও মৃত্যু ঘটালো।
কাজেই নারায়ণ পন্ডিতের উল্লিখিত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটির প্রেক্ষাপট খুবই পরিষ্কার এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে পন্ডিত এই শ্লোকটির ব্যবহারিক মূল্যের কথা বলেছেন। বিশেষ করে, যখন কোন অসৎ ব্যক্তি তা ব্যবহার করে। এই আখ্যানটি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোন আইডিয়াকেই তার পূর্ব ইতিহাস, প্রকৃতি তথা নিহিতার্থ বিচার না করে নির্বিচারে গ্রহণ করা উচিত না।
অবশ্যই হিতোপদেশের অনেক আখ্যানও আমাদের দেখার প্রয়োজন আছে, যেখানে এই শ্লোকটির নিহিতার্থ সম্বন্ধে আর কোন দ্বিধা থাকে না।
জরদগব শকুন ও দীর্ঘ কর্ণ বেড়াল
শেয়ালকে বিশ্বাস করার ব্যাপারে সুবুদ্ধি কাক চিত্রাঙ্গ হরিণকে এই আখ্যান শুনিয়ে নিয়ে সতর্ক করল:
“ভাগীরথী নদীর পাড়ে গৃধারাকুত নামে এক টিলার ওপর এক বিশাল ডুমুর গাছ ছিল। সেই গাছের কোটরে জরদগব নামের এক বৃদ্ধ শকুন বাস করত। বয়সের কারণে তার দৃষ্টিশক্তি কমে গিয়েছিল আর নখও ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল। ওই গাছে বাসরত অন্যান্য পাখিরা এই শকুনকে ভালোবেসে তাদের খাবার থেকে কিছু অংশ বুড়ো শকুনকে দিত। এইভাবে দিন চলছিল আর বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ পাখিদের বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণ করত ঐ শকুন।
একদিন যখন পাখিরা খাদ্যের খোঁজে দূরে অন্য জায়গায় চলে গেল, তখন দীর্ঘকর্ণ নামের এক বেড়াল খাবারের খোঁজে সেই গাছের তলায় এলো। বেড়ালকে দেখে বাচ্চা-পাখিরা ভয়ে আর্তনাদ করতে শুরু করলো। ফলে, জরদগব শকুন সচকিত হয়ে উঠলো। সে বলে উঠল, ‘কে ওখানে?’ এবার বড়ো একটা শকুনকে দেখে বেড়ালটা বুঝল যে, ওই শকুনের সঙ্গে লড়াই করে সে পারবে না। তখন সে একটা নতুন ফন্দি আঁটলো। সে উত্তরে শকুনকে বলল, ‘আর্য, আমার নমস্কার নেবেন’। শকুন জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’ দীর্ঘকর্ণ বলল, ‘আমি একটা সামান্য বেড়াল মাত্র’। শকুন চিৎকার করে উঠল, ‘তফাৎ যাও, বেড়াল। নতুবা আমি তোমাকে হত্যা করব’। বেড়াল উত্তর করল, ‘আমি যদি হত্যার যোগ্য হই, তাহলে আমাকে হত্যা করবেন। কিম্তু, তার আগে দয়া করে আমার কথা শুনুন’। জরদগব প্রত্যুত্তরে বলল, ‘ঠিক আছে। তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্য বলো’।
এবার নাটকীয়ভাবে দীর্ঘকর্ণ বলা শুরু করলো। ‘আমি তো গঙ্গার পাড়েই বাস করি। প্রতিদিন গঙ্গা স্নান করে চন্দ্রায়নব্রত পালন করি। ব্রতচারীর মত নিরামিষ ভোজন করি। ওখানে পাখিরা সব আসে, আপনার কথা বলে। আপনি পরম ধার্মিক ও শ্রদ্ধেয়। সেই কারণে আপনার কাছ থেকে নীতি ও ধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করতে আমি খুবই উৎসুক।‘
বেড়াল বলে যেতে লাগল, ‘আপনি এত ধর্মনিষ্ঠ যে, আমি বিস্মিত হচ্ছি, আপনি একজন অতিথিকে হত্যা করতে চাইছেন! ধর্মনীতি কি অতিথির সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে হবে, শেখায় না?’ বেড়াল তখন ধর্মশাস্ত্র থেকে এক লম্বা-চওড়া ভাষণ দিলো, যার সারমর্ম শান্তি ও অহিংস!
কিন্তু, জরদগব শকুন তাতে না ভুলে প্রশ্ন করল, ‘শোনো ভায়া, আমি শুধু জানি, তুমি একটি বেড়াল, আর বেড়াল মাংসাশী। যেহেতু বাচ্চা-পাখিদের আমি রক্ষা করছি, তাই শেষবারের মতো তোমাকে সতর্ক করছি, এখনি চলে যাও।‘
এই শুনে দীর্ঘকর্ণ বেড়াল আরো নাটকবাজি শুরু করলো। ভূমিতে সাষ্টাঙ্গ হয়ে দেবতাদের নামে শপথ নিয়ে বলল, ‘চন্দ্রায়ণব্রত পালন করে আমি সমস্ত আসক্তির উর্ধ্বে উঠেছি, শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, অহিংসা ধর্ম পালন করছি।‘
এইভাবে নাটক করে শকুনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বেড়াল শেষে সেই গাছের কোটরে থাকতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে শকুনের বিশ্বাস অর্জন করে শেষে বেড়াল তার আসল কাজ শুরু করলো, বাচ্চা-পাখিদের একে একে খেতে শুরু করল, আর হাড়গুলো শকুনের কোটরে ফেলতে থাকল।
একের পর এক বাচ্চাদের নিখোঁজ হওয়ার পর একদিন বাচ্চাদের মা-বাবা পাখিরা তাদের খোঁজ করা শুরু করল। চতুর বেড়াল তখন নিঃশব্দে পালিয়ে গেল, আর পাখিরা দেখল তাদের বাচ্চাদের হাড়গোড় জরদগব শকুনের কোটরে পড়ে রয়েছে। তারা তখন এই সিদ্ধান্তে এলো, বুড়ো শকুনই এসব কাণ্ড ঘটিয়েছে। ফলে, যা হবার তাই হল। প্রকৃত বন্ধু হয়েও নিজের ভুলের কারণে পাখিদের হাতে শকুনের প্রাণ গেল।
হিতোপদেশের উপরের আখ্যানটি হচ্ছে সেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটির উৎস যা সাবভারসনিষ্টরা ব্যবহার করে চলেছে।
এতোক্ষণে আমাদের কাছে পরিস্কার যে, প্রাচীন আচার্য নারায়ণ পন্ডিত তার ছাত্রদের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বনীতিকে অন্ধ ভাবে মেনে চলার শিক্ষা দেন নি, বরং উল্টো ভাবে এই আদর্শ নীতিকে অন্ধ ভাবে ব্যবহারের নীতির বিপক্ষেই সতর্ক হতে বলেছেন। কিম্তু, আধুনিক ভারতের নীতিনির্ধারকরা ও তাদের অনুসারীরা নারায়ণ পণ্ডিতের সতর্কবাণী উপেক্ষা করেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটিকে নীতি হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন।
The Hoax Called Vasudhaiva Kutumbakam-2: Panchatantra and Kautilya
By Sarvesh K Tiwan
‘বসুধৈব কুটুম্বকম’: ছলনার আরেক নাম -২ : পঞ্চতন্ত্র ও কৌটিল্য
-সর্বেশ কে তিওয়ান
দ্বিতীয় পর্ব
প্রথম পর্বে, হিতোপদেশের দুটি ব্যাঙ্গাত্মক গল্পকথার মধ্যে দিয়ে আমরা প্রাচীন রাজনীতিজ্ঞ আচার্যের কথিত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটির প্রেক্ষিত ও নিহিতার্থ বুঝতে চেষ্টা করেছি। এক নীতিআদর্শ বা সুপারিশ হিসেবে নয়, বরঞ্চ এই শ্লোকটিকে এক ধরনের ধূর্ত সাবভারসনিষ্টরা যেভাবে ব্যবহার করে, তার মর্মার্থ বুঝে মেকি ভ্রাতৃত্ব-প্রচারকদের বিশ্বাস করা থেকে দূরে থাকা, এবং ভাতৃত্ববোধের আবেগে ভন্ডদের বিশ্বাস করে বন্ধুত্ব করা ও আশ্রয় দিয়ে নিজের চরম সর্বনাশ করা থেকে বিরত থাকাই এই শ্লোকের নিহিতার্থ।
এই পর্বে আমরা সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যান্য উৎসগুলো, বিশেষত পঞ্চতন্ত্র এবং চাকণ্যের সংগ্রহগ্রন্থে এই শ্লোকের ব্যবহার ও নিহিতার্থ বোঝার চেষ্টা করব।
পঞ্চতন্ত্রে বসুধৈব কুটুম্বকম
হিতোপদেশ সংকলনগ্রন্থ হিসাবে গড়ে তোলার সময় নারায়ণ পন্ডিত অন্যান্য উৎসের সঙ্গে বিশ্বের সবথেকে বড় গল্পকথার সংকলন পঞ্চতন্ত্রকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। হিতোপদেশের মুখবন্ধে নারায়ণ পন্ডিত স্বীকার করে নিয়েছেন যে, পঞ্চতন্ত্র ও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে তিনি বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করেছেন:
“পঞ্চতন্ত্রাত্তথান্যস্মাত গ্রন্থাদ্কৃষ্য লিখ্যতে” (হিতোপদেশ ১.৯)
পণ্ডিতেরা নিশ্চিতভাবেই দেখিয়েছেন যে, হিতোপদেশ হচ্ছে পূর্বেকার দক্ষিণ-ভারতীয় পঞ্চতন্ত্রেরই পূর্ব-ভারতীয় প্রেক্ষিতে নবায়িত সংস্করণ। তাই, আচার্য বিষ্ণুশর্মার এই অভূতপূর্ব প্রাচীন আখ্যানকথা ‘পঞ্চতন্ত্র’ সম্ভবত সবথেকে বেশি অনূদিত ও প্রচারিত সাহিত্যকর্ম, যা সাধারণ পূর্বাব্দ তৃতীয় শতকে মৌর্য যুগের শেষের দিকে লিখিত হয়েছিল। যদিও কোন স্থানে এটা লিখিত হয়েছিল সে ব্যাপারে বহুমত আছে। কারো মতে কাশ্মীর বা নেপাল, কারো মতে তা দক্ষিণ ভারত। কিন্তু, এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই যে, এই পঞ্চতন্ত্রটি লিখিত হওয়ার পর তা প্রায় সমসাময়িক প্রধান সব সভ্যতাতেই প্রচারিত হয়েছিল। ফলস্বরূপ, পঞ্চতন্ত্রের পরিবর্তিত রূপ আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ভাষাতে – পহ্লবী, পারসিক, সিরিও, তুর্কি, গ্রিক ও ল্যাটিন, হিব্রু, আরবীয়, তিব্বতী ও চৈনিক ভাষায়। ইউরোপের বিভিন্ন গল্পকথা, যেমন, ফিলপে, ঈশপ, গ্রিমের গল্পকথা এবং পারসিক-আরবীয় সাহিত্যের গল্পকথাগুলির উৎস সেই পঞ্চতন্ত্র।
পঞ্চতন্ত্রের যে স্তরায়িত গল্প-আখ্যানের কাঠামো, হিতোপদেশ শুধু তাই অনুসরণ করেনি; এমনকি, সরাসরি বিভিন্ন শ্লোকের ব্যবহারও করেছে। সেই রকম একটি শ্লোকই হলো এই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি। পঞ্চতন্ত্রের পঞ্চম তন্ত্র ‘অপরিলক্ষিতকারকমে’ বিষ্ণুশর্মা এই শ্লোকটিকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘সীমাকারক মূর্খ ব্রাহ্মণ কথা’ আখ্যানে এবং এক বোকা লোকের মুখে এই শ্লোকটিকে বসিয়েছিলেন। তাই, এই শ্লোকের প্রেক্ষিত বোঝাতে সংক্ষিপ্তাকারে সেই আখ্যানটিকে নিচে দেওয়া হল:
“কোন এক কালে এক অখ্যাত গ্রামে চার তরুণ ব্রাহ্মণ বন্ধু বাস করত। এই চারজনের মধ্যে তিনজন ছিল একেবারেই বোকা, যদিও তারা শাস্ত্রজ্ঞ ছিল। অন্যপক্ষে, চতুর্থজন, যদিও শাস্ত্রজ্ঞ ছিল না, কিন্তু বুদ্ধিমান ও বাস্তব জ্ঞানের অধিকারী ছিল।
একদিন প্রথম তিনজন শাস্ত্রজ্ঞ বন্ধু ঠিক করল, তারা নগরে গিয়ে তাদের বিদ্যাবুদ্ধিকে ব্যবহার করবে। আদতে, খ্যাতি-অর্থ অর্জন করা যদি না যায়, তবে এই শাস্ত্রজ্ঞানের কি মূল্য? দলের সবাই এই ভাবনাকে স্বীকার করে দূরে এক বড় নগরের দিকে রওনা দিল।
নগরের পথে যেতে যেতে চার বন্ধুর মধ্যে সবথেকে বড় শাস্ত্রজ্ঞ বন্ধু বলে ফেলল, আমাদের এই যাত্রায় শাস্ত্রজ্ঞানহীন মূর্খ বন্ধুর থাকা তো অপ্রয়োজনীয়। সে বলল, ওই বন্ধুর বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে যেহেতু সেই বন্ধুর কোন প্রথাগত শিক্ষার নেই, তাই এই যাত্রায় ঐ বন্ধুর থাকার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় শাস্ত্রজ্ঞ বন্ধুও সেই প্রস্তাবে সহমত পোষণ করল এবং পরামর্শ দিল যে, মূর্খ বন্ধুর গ্রামে ফিরে যাওয়াই ভালো।
অবশ্য, তৃতীয় শাস্ত্রজ্ঞ বন্ধু সহৃদয় ছিল। সে সবাইকে মনে করালো যে, চতুর্থ বন্ধু তাদের বাল্যবন্ধু। তাই তাদের এই অভিযানে তারও অংশীদারিত্ব আছে। ঠিক এই সময়ে ঐ তৃতীয় বন্ধুর মুখে শোনা গেল সেই বিখ্যাত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি এবং প্রথম দুই বন্ধুকে রাজি করালো চতুর্থ বন্ধুকে তাদের দলে রাখতে। এরপর তারা নগরের দিকে এগিয়ে চলল।
কিছুদুর এগিয়ে চলার পর চার বন্ধু দেখল একটি মৃত প্রাণীর ছড়ানো-ছিটানো কঙ্কাল। সেই কঙ্কাল দেখেই প্রথম তিন বিদ্বান বন্ধু ঠিক করল, তারা ঐ কঙ্কালের উপর তাদের বিদ্যার পরীক্ষা করবে।
প্রথম বোকা বিদ্বান তার অধীত অস্থিবিদ্যার দ্বারা সব হাড়গোড়গুলোকে যথাযথভাবে পুনঃস্থাপিত করল। দ্বিতীয় জন তার বিদ্যা দ্বারা সেই পূর্ণ-কঙ্কালের উপর অস্থি-মজ্জা-মাংস-চামড়া পুনঃস্থাপিত করল। আর ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বাণীদাতা তৃতীয় বোকা-বিদ্বান তার অধীত বিদ্যার দ্বারা এবার সেই মৃত প্রাণীটিকে পুনরায় প্রাণ-দানের পরীক্ষা শুরু করল।
ঠিক এই সময়ে, চতুর্থ বন্ধু, যে যদিও অশিক্ষিত কিন্তু বুদ্ধিমান ও কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন ছিল, সবাইকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। সে বলে উঠল, ‘বন্ধুরা, একটু দাঁড়াও। শোনো, এই মৃত প্রাণীটিকে সিংহ বলে মনে হচ্ছে এবং তোমরা এই মৃত সিংহকে বাঁচাতে চেষ্টা করছ। এমন করলে, বিদ্বান বন্ধুরা, আমাদের সকলেরই প্রাণসংশয় হবে। তাই তোমাদেরকে সনির্বন্ধ অনুরোধ, মৃত প্রাণীটিকে যেমন আছে তেমনি থাকতে দাও। আর, চলো আমরা নিজেদের গন্তব্যে এগিয়ে চলি।‘
কিন্তু, ‘বসুধৈব’ বাণীদাতা সেই বোকা-বিদ্বান তৃতীয় বন্ধুটি সাধারণ কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন সেই সতর্কবাণী উপেক্ষা করল।
শেষে, বিদ্বান বন্ধুদের এই আত্মঘাতী বোকামির কাজ করতে দেখে সেই কান্ডজ্ঞানী চতুর্থ বন্ধুটি কাছের একটা উঁচু গাছে উঠে পড়ল। তারপরে যা হবার তাই হল। বাণীদাতা তৃতীয় বন্ধুটি মৃত সিংহকে প্রাণ করতে পারল এবং তখনই সিংহটি বেঁচে উঠে তিন বোকা-বিদ্বান ব্রাহ্মণকে হত্যা করল। শুধুমাত্র বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন বন্ধুটি, যে গাছের উপর উঠে পড়েছিল সে শুধু বাঁচতে পারল, তিন বন্ধুর মর্মান্তিক পরিণতি এড়াতে পারল। গ্রামে ফিরে সে তিন বন্ধুর বোকামি, বিশেষতঃ ঐ ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বাণীদাতা বন্ধুর চরম বোকামির জন্য শোক করতে লাগল।“
পঞ্চতন্ত্রে এই সেই গল্পকথা যেখানে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি স্থান পেয়েছে।
যদিও নিশ্চিতভাবেই হিতোপদেশে নারায়ণ পন্ডিত ওই শ্লোকটিকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু বিষ্ণুশর্মা এই শ্লোকটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেন নি। বিষ্ণুশর্মা সরাসরি তৃতীয় বিদ্বানটিকে মূর্খ বলে ঘোষণা করেছিলেন ও পরে তার মুখ দিয়েই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে উচ্চারিত করিয়েছিলেন। চতুর্থ বন্ধুকে দলে রাখার জন্য বোকা ব্রাহ্মণ যুবকটি ঐ শ্লোকটিকে ব্যবহার করেছিল একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও অবান্তর ভাবেই। তাই, এটা ভাবা খুবই সঙ্গত যে, বিষ্ণুশর্মা এই শ্লোকটিকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই এক বোকা-বিদ্বান চরিত্রের মুখে বসিয়েছিলেন, যাতে এই শিক্ষা দেয়া যায় যে, অশিক্ষিত কান্ডজ্ঞান তথাকথিত শাস্ত্রজ্ঞানের থেকে বেশি মূল্যবান।
তাছাড়াও, মহান বিষ্ণুশর্মা ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকের প্রতি তার মনোভাব কখনোই গোপন করেননি, যখন তিনি এই শ্লোকের বাণীদাতাকে ‘বোকা’ বলে ঘোষণা করেছেন, যে নিজেই নিজের মুর্খামিতে নিহত হয়েছে। হিতোপদেশেও ঐ শ্লোক-দাতা শেয়ালকেও প্রকৃত নায়ক সুবুদ্ধি কাক হত্যা করেছিল।
তাই, এখন আমরা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের অবকাশ পেরিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, নীতিশিক্ষার ক্ষেত্রে - পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ - দুটি গ্রন্থই জাগতিক ব্যাপারে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের নিঃশর্ত ব্যবহারের ব্যাপারে খুবই ক্রিটিক্যাল ছিল। ঐ শ্লোকের ব্যাপারে দুটি গ্রন্থই খুব পরিষ্কার ও দ্বর্থহীন মত দিয়েছে: প্রথমত, ভ্রাতৃত্ববোধক বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি হচ্ছে সাবভারসনের এক লোকপ্রিয় পদ্ধতি; দ্বিতীয়ত, অতিসরলরা খুবই বোকার মতো এর দ্বারা প্রভাবিত হয়; এবং তৃতীয়ত, দু’পক্ষই শেষে ধ্বংস হয়।
বসুধৈব কুটুম্বকম এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র
পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ - নীতি শিক্ষার দুটি গ্রন্থেই ইতিহাস-পুরাণ ও আরো প্রাচীন নীতি শিক্ষার বিভিন্ন শ্লোকের ব্যবহার দেখা যায়। এই দুটি গ্রন্থেই একজন প্রধান লেখকের নাম পাওয়া যায়। তিনি হলেন বিষ্ণুগুপ্ত ওরফে চাণক্য বা কৌটিল্য। বস্তুতপক্ষে, পঞ্চতন্ত্রের মুখবন্ধে প্রথম দুটি লাইনেই বিষ্ণুশর্মা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে কৌটিল্যকে একজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান হিসেবে স্মরণ করেছেন এবং স্বীকার করেছেন যে, তিনি পঞ্চতন্ত্র সংকলিত করার আগেই চাণক্যের অর্থশাস্ত্র যথাবিহিত ভাবে অধ্যায়ন করেছেন:
“মনবে বাচস্পতয়ে শুক্রায় পরাশরায় সসুতায়
চাণক্যায় চ বিদুষে নমোস্তু ন্যায়শাস্ত্র-কর্তুভ্যঃ।
সকলার্থ শাস্ত্রসারং জগতি সমালোক্য বিষ্ণুশর্মেদম
তন্ত্রৈঃ পঞ্চভির এতচ্চকার সুমনোহরং শাস্ত্রং।।“ (পঞ্চতন্ত্র ১.২)
মৌর্য সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণ এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই সাম্রাজ্যকে সুসংহত করে কৌটিল্য অবসর নিয়ে দক্ষিণ ভারতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব-তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কৌটিল্য তার নিজস্ব ভাবনা দিয়ে রচনা করেছিলেন ‘অর্থশাস্ত্র’। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন বিদ্যা একটি সাধারণ শাস্ত্রের মধ্যেই সংকলিত হতে থাকে। তবে, পরে এইভাবে এইসব শাস্ত্রজ্ঞান এক জায়গায় সংগ্রহ করে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পরে দেখা যায়, হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞরা সেই সাধারণ শাস্ত্রজ্ঞানকে জীবন-জগতের বিভিন্ন বিষয় অনুযায়ী বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত করেছেন- ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র ইত্যাদি। এমন কি, পরে আরো সূক্ষ্ম বিষয়ের উপর শাস্ত্র গড়ে তুলেছেন। যেমন, নাটকের জন্য নাট্যশাস্ত্র, রন্ধনের জন্য রন্ধনশাস্ত্র/পাকশাস্ত্র ইত্যাদি।
তাই, কৌটিল্যের বিভিন্ন কাজকে দেখতে হবে একটি মাধ্যম হিসেবে যার দ্বারা আমরা প্রাচীন হিন্দুদের রাজনৈতিক দর্শনকে বুঝতে পারব, যা শুধু কৌটিল্যের সমসাময়িক নয়, তারও আগের থেকেই ধারাবাহিকভাবে গড়ে উঠেছিল। প্রকৃতপক্ষে, অর্থশাস্ত্র রচনা করতে গিয়ে কৌটিল্য কমপক্ষে পাঁচটি রাজনৈতিক দর্শনের উল্লেখ করেছেন – মানব, বাহর্স্পত্য, ঔশোনাস, পরাশর ও অমব্যাল্য, এবং কমপক্ষে তেরো জন পণ্ডিতের নাম উল্লেখ করেছেন – ভরদ্বাজ, বিশালাক্ষ, পরাশর, পূষণ, কৌনপদন্ত, ভাতব্যয়াদি, বহুদন্তি-পুত্র, কাত্যায়ণ, কনিকা-ভরদ্বাজ, দীর্ঘ-বরায়ণ, ঘটক-মুখ, কিঞ্জল এবং পূষণ-পুত্র। এখানে এটা বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, কৌটিল্য তার পূর্বেকার পণ্ডিতদের সঙ্গে যেখানে মতের মিল হয়েছে, তা যেমন বলেছেন; তেমনি যেখানে তিনি সহমত হননি, সেগুলোও উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি প্রথমে তাদের মতামত উল্লেখ করেছেন, পরে ব্যাখ্যাসহ নিজের মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন।
উপরের অংশগুলোকে আমাদের মূল বিষয়ের সাপেক্ষে প্রক্ষিপ্ত মনে হতে পারে। কিন্তু সেগুলি জরুরি। কারণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের প্রেক্ষাপট বিচার করলে আমরা অনুধাবন করতে পারব যে, নীতি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাচীন আচার্য্যদের বক্তব্য, যদিও তা এখন আমাদের কাছে লভ্য নয়, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মাধ্যমে আমাদের কাছে পরিস্ফুট হয়েছে। কাজেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি যে অর্থশাস্ত্রে নেই, তার কারণ ওই শ্লোকের মূলভাব প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রভাবনার পরিপন্থী ছিল।
যদি রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ঐ শ্লোকটিকে নিঃশর্ত ভাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা ভীরুতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতা হিসেবেই বিবেচিত হবে, অর্থহীন বোকাবোকা ভাই-ভাই স্লোগানের মত মনে হবে। এই ধরনের ব্যবহার রাষ্ট্রকে এক ‘নরম রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরবে, যা রাষ্ট্রকে শাসনহীন নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেবে। আর, কৌটিল্য অবশ্যই এই ধরনের রাষ্ট্রকে নিন্দা করেছেন।
এই ধরনের রোমান্টিক-নৈরাজ্যবাদী ভাবনার বিপরীতে কৌটিল্য ছিলেন একজন বাস্তববাদী, এবং মানুষ ও মনুষ্য-সমাজ সম্পর্কে তার বিশ্ববীক্ষার ভিত্তিভূমি ছিল কঠোর বাস্তবতা। রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘ভ্রাতৃত্বনীতিকে’ তিনি মূল ভিত্তি হিসেবে ধরেননি, বরং ‘দুর্জনকে শাস্তি দানের ক্ষমতাকেই’ তিনি রাষ্ট্রনীতির অন্যতম ভিত্তি বলে গণ্য করেছিলেন। অর্থশাস্ত্রের প্রথম বইতে কৌটিল্য বলেছেন,
‘অপ্রণীতো হি মাৎস্যন্যায়ম উদ্ভাবয়ন্তি বলীয়ান, অবলম হি গ্রসতে দন্ডধর অভাবে’
‘পরিবার হিসেবে নয়, মনুষ্য-সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জলে থাকা মাছেদের মাছ মতো যেখানে শক্তিশালী মাছগুলো দুর্বল মাছেদের আক্রমণ করে, যদি না তাদেরকে এই আক্রমণ করা থেকে বিরত করার জন্য প্রতিহত করা হয়।‘ সেই জন্য দণ্ডনীতি, যা রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, তা রাষ্ট্রনীতির মূল হিসেবে ধরতে হবে। সমাজের চালিকাশক্তিই হল অর্থ, যা ধর্মনীতির মাধ্যমে অর্জন করতে হবে এবং শুধুমাত্র দন্ডনীতিই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
এই বিশ্ববীক্ষার ক্ষেত্রে কৌটিল্য পেয়েছেন ভীষ্মকে (যাকে তিনি কৌনপদন্ত বলেছেন), যিনি মহাভারতের সাতষট্টিতম অধ্যায় শান্তিপর্বে একই নীতির কথা বলেছিলেন। ঋষি মনুও একই ধরনের মত দিয়েছেন:
“যদি ন প্রণয়েত রাজা দন্ডম দন্ডস্বতন্দ্রিতঃ জলে মৎস্যানিবাহিংস্যান দুর্বলান বলবত্তরাঃ” (মনুস্মৃতি ৭.২০)
“যদি রাষ্ট্র, যাদের উপর যথাযথভাবে দন্ডনীতি প্রয়োগ করা দরকার, তা না করে; তাহলে দুষ্টু লোক শক্তিশালী মাছের মত সৎ ও দুর্বল লোকের উপর আক্রমণ করবে।“
তাই, এইসব আচার্য-পন্ডিতেরা খুবই পরিষ্কার ছিলেন যে, যদি রাষ্ট্রশাসকরা তাদের প্রাথমিক কর্তব্য না করে, বসুদেব কুটুম্বকম শ্লোকের দোহাই দিয়ে দণ্ডনীতি না ব্যবহার করে; তবে কোনোই কুটুম্বিতা/আত্মীয়তা থাকবে না, সমাজে চালু হবে মাৎস্যন্যায়।
তাই, ‘সারা পৃথিবী এক পরিবার’ মডেলের পরিবর্তে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এটাই বলতে চেয়েছে, শঠতা ও শত্রুতা রাষ্ট্রীয় তথা সমাজজীবনে আছেই এবং রাষ্ট্র-পরিচালনার ক্ষেত্রে এক কঠোর মনোভাব দরকার, সেইসব অন্যায় থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য। দেশের শত্রুদের চিহ্নিত করে তাদেরকে কঠোরভাবে দমন করা রাষ্ট্রনায়কদের অবশ্যকর্তব্য, যাতে সমাজ জীবনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। তাই, কৌটিল্যের কয়েকটি বিখ্যাত উক্তি দেখা যাক: ‘বনে যেমন সব গাছ চন্দনগাছ নয়, যেমন সব হাতি মানিক্যযুক্ত নয়, তেমনি মনে রাখা দরকার যে, সবাই ভদ্রজন নয়’; ‘প্রত্যেকেই যেভাবেই হোক নিজের লোকেদের রক্ষা করা উচিত এবং শত্রুদেরকে আক্রমণ করা দরকার’, ‘হে প্রভু, আমাদের শত্রুদের, যদিও তারা এক বড় চক্র, তাদেরকে ধরাশায়ী করুন; সর্বশক্তি দিয়ে তাদেরকে দমন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না।‘
তাই, আমার বিশ্বাস, আমরা বলতেই পারি যে, কৌটিল্যের মতানুযায়ী ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ নীতির রোমান্টিক নৈরাজ্য নয়, বরং দেশশাসকরা বাস্তবজ্ঞানে শত্রু-মিত্র-ভেদ করে শাসননীতি প্রয়োগ করবেন এবং সমাজের শান্তির জন্য নির্দ্বিধায় নৈরাজ্যবাদীদের দমন করবেন।
কৌটিল্যের অন্যান্য রচনায় বসুধৈব কুটুম্বকম
অর্থশাস্ত্র ছাড়াও আরো কয়েকটি সংগ্রহগ্রন্থে চাণক্যের নাম পাওয়া গেছে এবং সেইগুলিতে চাণক্যের নামে কয়েকশো নীতিবচনের উল্লেখ পাওয়া গেছে। কিছু জনপ্রিয় সংক্ষিপ্তসারে, যেখানে চাণক্যের উল্লেখ আছে, সেগুলি হলো: লঘু-চাণক্য, বৃদ্ধ-চাণক্য, চাণক্য-নীতি-দর্পণম্, চাণক্য-নীতিশাস্ত্র, চাণক্যনীতি-শতক, চাণক্য-রাজনীতি-শাস্ত্র, চাণক্যম, চাণক্য-শতকম, চানক্যনীতি-ব্যবহার-সারসমগ্র, চাণক্য-সূত্রনী,এবং রাজনীতি। উপরের উল্লেখিত সংগ্রহের অল্প কিছুই প্রকাশিত হয়েছে, বেশিরভাগই পান্ডুলিপি আকারেই পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রন্থাকারে রক্ষিত আছে।
উপরের তালিকার মধ্যে প্রথম চারটি, যথা, লঘু-চাণক্য, বৃদ্ধ-চাণক্য, চাণক্য-নীতি-দর্পণম্ ও চাণক্য-নীতিশাস্ত্র গ্রন্থ গুলি বহুচর্চিত গ্রন্থ এবং সেগুলির পান্ডুলিপি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেই পাওয়া গেছে। কাজেই প্রথম চারটি সংগ্রহ অবশ্যই প্রাচীন, যা চাণক্যের নিজের লেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, সংগ্রহকর্তারা চাণক্যের নাম ব্যবহার করেছেন সেগুলির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে।
‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একমাত্র ‘বৃদ্ধ-চাণক্য’ গ্রন্থেই ঐ শ্লোক পাওয়া যাচ্ছে, যা হচ্ছে তাঞ্জোর সংশোধিত সংস্করণ। আর চাণক্য-নীতি-শাস্ত্রের এক সংস্করণেও আছে। চাণক্যের নীতিবচনের অন্যান্য সকল সংগ্রহগ্রন্থেই এই শ্লোকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই, অনুমান করা যায়, এই শ্লোকের উপস্থিতি কিছু পন্ডিত অন্যান্য গ্রন্থ থেকে চাণক্যের নামে উল্লেখ করেছেন।
লুডউইগ স্ট্যার্নবাক বিভিন্ন সংগ্রহগ্রন্থ থেকে চাণক্যের বিভিন্ন উক্তি বিচার-বিশ্লেষণ করে একটি অনন্য গ্রন্থ লিখেছেন। উনি পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করে তার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি চাণক্যবিযুক্ত বিভিন্ন উৎস গ্রন্থ থেকে পরবর্তী সময়ে চাণক্য নামযুক্ত বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
স্ট্যার্নবাক আরো দেখিয়েছেন যে, চাণক্যের নামে বিভিন্ন উক্তি আসলে আরো পূর্বের মহাভারত থেকে সংগৃহীত হয়েছে।
সর্বোপরি, অর্থশাস্ত্রে চাণক্যের মূল ভাবনা-চিন্তাকে যদি পর্যালোচনা করা যায়, তবে এটা ভাবা অসম্ভব যে, রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে চাণক্য ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’কে এক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
আসলে এই শ্লোকের ব্যবহারনীতি আধুনিক ভারতের দেশশাসকদের এক অভাবনীয় উদ্ভাবন!
The Hoax Called Vasudhaiva Kutumbakam-3: Vikrama, Poetics and Upanishada
By Sarvesh K Tiwan
‘বসুধৈব কুটুম্বকম’: ছলনার আরেক নাম -৩ : বিক্রম, কাব্যতত্ত্ব ও উপনিষদ
-সর্বেশ কে তিওয়ান
তৃতীয় ও শেষ পর্ব
আগের দুই পর্বে (১: হিতোপদেশ, ২: পঞ্চতন্ত্র ও চাণক্য) আমরা দেখেছি, বসুধৈব কুটুম্বকম নীতিবচনকে প্রাচীন নীতিশাস্ত্রগুলি কোন ভাবে দেখেছে। এই শেষ পর্বে, আমরা বাকি উৎসগুলোতে এই নীতিবচনকে কোন প্রেক্ষাপটে বিচার করা হয়েছে, তা বুঝতে চেষ্টা করব।
বিক্রম-চরিতে বসুধৈব কুটুম্বকম
শতাব্দী পেরিয়ে হিন্দু মনোজগতে স্থান করে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিহাস-খ্যাত ধারাবতীর ভোজদেব পারমার রাজ-ঐতিহ্যের স্থান অতুলনীয়। অন্যান্য রাজারা যেখানে শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে, সেখানে এই রাজার রাজ-ঐতিহ্য এখনো বহমান বিভিন্ন ধারায় - নাগরিক প্রবাদে, গ্রামীণ লোকসংগীতে, চড়াদাগের জোকস, পাণ্ডিত্যপূর্ণ পুরাণকথায়, জনপ্রিয় লোককথা – এসবই অনুপ্রাণিত হয়েছে সিংহাসন-বত্তিসি ওরফে দ্বাত্রিংশ-পুত্তলিকা-সিংহাসনম ওরফে বিক্রম-চরিত।
মনে করা হয়, সাধারণাব্দীয় একাদশ শতকে ভোজরাজের সময়ে বা তার কিছু পরেই, বত্রিশটি গল্পকথার সংকলন লিখিত হয়েছিল এবং তারপরেই ১৩০৫ সালের মধ্যেই এই গল্পকাহিনী এতো জনপ্রিয় হয়েছিল যে, তা এমন কি বহু দূরের মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, সেখান থেকে তা পরে রাশিয়া ও জার্মানিতে পৌঁছেছিল। যার ফলে, এমনকি আজও ‘অর্জি বুজি’ (রাজা ভোজ থেকে) নামে এক নায়ককে মঙ্গোলিয়ার লোককথায় পাওয়া যায় এবং জার্মানিতে গ্রিমের গল্পকথায় অন্ততপক্ষে একটি গল্পের উৎস হচ্ছে এই বিক্রম-চরিত।
এই গল্পকথার কাঠামোটা এমনই যে, প্রত্যেক গল্পেই বত্রিশ-পুতুলের দ্বারা ধরে রাখা সিংহাসনে রাজা ভোজ আরোহণ করতে চেষ্টা করে। আর প্রত্যেকবারই একজন করে পুতুল রাজা ভোজকে মহান বিক্রমাদিত্যের একটা করে গল্প বলে এবং রাজা ভোজের কাছে জিজ্ঞাসা করে, তিনি এমন মহান কিনা। প্রত্যেকটা গল্প শুনেই রাজা ভোজ নিঃশব্দে বিনয় সহকারে সিংহাসন আরোহণ করা থেকে বিরত থাকেন এবং শেষে ‘ঈশ্বরের আদেশে’ তিনি রাজ-সিংহাসনের জন্য উপযুক্ত ঘোষিত হন, যা লেখকের এক প্রতীক-উপায়, যার মাধ্যমে রাজা ভোজকে মহান বিক্রমাদিত্যের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এই জনপ্রিয় গল্পকথার সংকলনেই পরে আমরা সেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটিকে পাই, যা ইতিবাচক রূপেই দেখানো হয়েছে। বিক্রম-চরিতের ছয়টা প্রধান সংকলন পাওয়া গেছে: দক্ষিণ ভারতীয় সংকলন, যার পান্ডুলিপি অন্ধ্রে পাওয়া গেছে; অনুষ্টুপ ছন্দে লিখিত একটি সংকলন; একটি সংক্ষিপ্ত গদ্য সংকলন; প্রধানত মধ্য ও পশ্চিম ভারত থেকে দেবনাগরী লিপিতে দুটি জৈন সংকলন গ্রন্থ; এবং শেষে ভারুচির সংকলন গ্রন্থ। এছাড়াও আরেকটি জনপ্রিয় গল্পকথার সংকলন পাওয়া যায়, যেখানে বিক্রম-চরিত পাওয়া যায়, যা বেতাল পঞ্চবিংশতি বা বেতাল-পচিশি: পঁচিশটি বেতাল গল্পকথার সমাহার নামে পরিচিত, যেগুলির উৎস বত্রিশ সিংহাসনের গল্প।
ওপরের ছয়টি সংগ্রহগ্রন্থের মধ্যে তিনটি আলাদা আলাদা গ্রন্থে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি পাওয়া গেছে।
দক্ষিণ ভারতীয় সংগ্রহগ্রন্থের তেলেগু পাণ্ডুলিপিতে এই শ্লোকটি একটি গল্পের প্রথমেই পাওয়া গেছে, যেখানে সুপ্রভা নামের তৃতীয় পুতুলটি সর্বস্ব-দক্ষিণা-যজ্ঞ-বর্ণানাম গল্পে শ্লোকটি রাজা ভোজকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল। এখানে, জনপ্রিয় আঙ্গিকের পরিবর্তে এই শ্লোকটি ভিন্নভাবে উল্লেখিত হয়েছে:
“অয়ম্ নিজ পরবেতি বিকল্প ভ্রান্ত-চেতসাম পুনস্তুদার চিন্তানাম বসুধৈব কুটুম্বকম” (বি.চ., অন্ধ্র, ৩.১)
এই গল্পের বিষয়ই হলো, বিক্রমাদিত্যের বৈরাগ্যের বিজয় বার্তা। একবার রাজা উজ্জয়িনীতে এক রাজসূয় যজ্ঞ করবেন বলে মনস্থির করে সমুদ্র-দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এক ব্রাহ্মণকে দূত হিসেবে দক্ষিণে পাঠালেন। যদিও সমুদ্র-দেবতা আসলেন না, তবে তিনি ব্রাহ্মণের মাধ্যমে রাজা বিক্রমাদিত্যকে চারটি বিরল রত্ন উপহার হিসেবে পাঠালেন, প্রত্যেক রত্নেরই আলাদা ধরনের জাদু ক্ষমতা ছিল। কিন্তু, উজ্জয়িনীতে সেই দূত ফিরে আসার আগেই রাজার যজ্ঞ শেষ হয়ে গেল এবং রাজা সবাইকে সব উপহার বিতরণ করে দিয়েছিলেন। ফলে, তার কাছে আর কিছুই না থাকার জন্য, রাজা সেই ব্রাহ্মণ-দূতকে বললেন, সেই চার রত্নের মধ্যে নিজের পছন্দ অনুযায়ী যে কোনো একটি রত্ন উপহার হিসেবে বেছে নিতে। ঠিক এই সময় কোন রত্ন বেছে নেবেন, তা নিয়ে সেই ব্রাহ্মণ, তার পত্নী, পুত্র ও পুত্রবধূর মধ্যে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক শুরু হলো। শেষে, তারা যখন কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না, তখন রাজা বিক্রমাদিত্য নিজের কাছে ধন-সম্পদ না থাকলেও চারটি রত্নই সেই ব্রাহ্মণকে দিয়েদিলেন।
জৈন গ্রন্থে এই বসুধৈব শ্লোকটিকে বলতে দেখা যাচ্ছে চিত্তাকর্ষক পরোপকার্য-স্বদেহহুতি-দান আখ্যানে, যেখানে সুপ্রভা হচ্ছে সতেরোতম পুতুল। এই গল্পটি বিক্রমাদিত্যের মহানুভবতা ও তার দানশীলতাকে তুলে ধরেছে। এই গল্পে দেখা যায়, বিক্রমাদিত্যের মহানুভবতার প্রশংসা শুনে এক অখ্যাত রাজ্যের রাজা খোঁজ নিচ্ছেন, বিক্রমাদিত্যকে কেন মহান বলা হচ্ছে। তিনি জানতে পারলেন, বিক্রমাদিত্যের অপর দানশীলতার জন্যই তাকে মহান বলা হচ্ছে। তখন ঈর্ষাকাতর হয়ে সেই অখ্যাত রাজা স্থির করলেন, তিনিও প্রচুর ধন-সম্পদ দান করবেন। কিন্তু, পর্যাপ্ত ধন-সম্পদ না থাকার জন্য তিনি তন্ত্র-প্রয়োগের মাধ্যমে ধন-সম্পদ সৃষ্টি করার কথা বিবেচনা করলেন। তিনি চৌষট্টিজন তন্ত্র-যোগিনীকে নিয়োগ করলেন এক বিশেষ তন্ত্র-যজ্ঞ করে প্রত্যেকবার যাতে পরিমাণ মতো সোনা-দানা পাওয়া যায়। অবশ্য, এই যজ্ঞে প্রত্যেকবারই রাজাকে নিজের দেহকে আহুতি দিতে হতো, যা যোগিনীরা যজ্ঞ শেষে নতুন দেহ হিসাবে ফিরিয়ে দিত। এই যন্ত্রণাদায়ক যজ্ঞ কয়েকবার করার পর এই খবর বিক্রমাদিত্যের কানে গিয়ে পৌঁছাল। সেই জন্য, একদিন এই যজ্ঞ চলাকালীন বিক্রমাদিত্য স্বয়ং উপস্থিত হয়ে আহুতি দেওয়ার সময়ে নিজেকে যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিলেন। এতে যোগিনীরা অত্যন্ত প্রীত হল, এবং বিক্রমাদিত্যকে পুনর্জীবিত করে তাকে এক বিশেষ ক্ষমতা বর দান করল। এই গল্পের ক্লাইম্যাক্স হলো, বিক্রমাদিত্য যোগিনীদের কাছে প্রার্থনা করলেন, যাতে সেই ঈর্ষান্বিত রাজাকে এই যন্ত্রণাদায়ক যজ্ঞাহুতির মাধ্যমে ধন-সম্পদ না পেতে হয়।
অন্য আরেকটি জৈন গ্রন্থে এবং ১৪৩৭ সাধারণাব্দে পন্ডিত শুভশীল গণীর লেখাতে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে আরেকটি গল্পে আবার পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বিক্রমাদিত্যের ন্যায়পরায়ণতাকে দেখানো হচ্ছে।
অন্যান্য সংকলনগ্রন্থে এই শ্লোকটিকে পাওয়াই যাচ্ছে না। কাকতালীয়ভাবে, রাজা ভোজদেবও কৌটিল্যকে উল্লেখ করে একটি সুভাষিতগ্রন্থ লেখেন (বা, লেখার ব্যবস্থা করেন), যার নাম চাণক্য-রাজনীতি-শাস্ত্র এবং এই শ্লোককে সেখানে আর পাওয়া যাচ্ছে না।
এইভাবে বিক্রম-চরিতে আমরা বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে পাই রাজা বিক্রমাদিত্যের মহানুভবতা ও ন্যায়পরায়ণতার নিদর্শন হিসাবে। কিন্তু, তা কোনোভাবেই আজকের সর্বজনীন ভাতৃত্ববোধক নীতি-আদর্শের ভুল ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।
ধ্রুপদী সাহিত্যে বসুধৈব কুটুম্বকম
এখন বিক্রম-চরিতের বিভিন্ন সংকলনগ্রন্থের লেখক যদি নায়ক হিসেবে বিক্রমাদিত্যের মহানুভবতা দেখানোর জন্য বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে উল্লেখ করে থাকেন, তবে তা নিশ্চয়ই মহত্ত্বের নিদর্শন হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, এই শ্লোকটি উদাহরণ হিসেবেই বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন হল, তার উৎসগুলি কি?
আমাদের বুঝতে হবে, এইসব সংকলনগ্রন্থের রচনাকালে সংস্কৃত সাহিত্যে কাব্যতত্ত্ব ইতিমধ্যেই একটা শাস্ত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এই সময়কালে শুধুমাত্র সংস্কৃত সাহিত্যিকরা নয়, সমাজের উচ্চবর্গের মধ্যেও - ভাবাবেগের চরিত্রায়ণে, প্রকাশভঙ্গিতে, বিশেষ উদ্দেশ্যে সঠিক ছন্দোবদ্ধতায়, ব্যাকরণের সীমার মধ্যেই কাব্য-স্বাধীনতা, নতুন শব্দভান্ডারের প্রয়োগ পদ্ধতি - এসবই চর্চিত হচ্ছে। কাব্যতত্ত্বের বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রধান ধারা, যেমন, বৈদর্ভ, কাশ্মীরি, গৌড়ীয় ধারা ইত্যাদি গড়ে উঠেছে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, এই সময়ে কোন সাধারণ টেক্সট থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুভাষিতগুলির বিশ্বকোষের মতো সংকলনগুলি এবং সাধারণ্যে প্রচলিত বিভিন্ন প্রবাদ, নীতিমালাগুলি ব্যবহৃত হতে শুরু হয়ে গিয়েছে। এই সংকলনগুলি, যেগুলি কোষ বা সমগ্র নামে পরিচিতি লাভ করেছে, সেগুলিকে নাট্যবিদরা, গদ্য-লেখকরা যেমন, বিক্রম-চরিতের লেখকরা স্থান-কাল-পাত্র-ভেদে ব্যবহার করা শুরু করেছেন।
বল্লবদেবের সুভাষিতাবলী এমনই এক সংগ্রহসমগ্র, যেখানে বিভিন্ন কবি-লেখকদের কয়েক হাজার কাব্য-লিখন বিষয়ভিত্তিক ভাবে সংগৃহীত হয়েছে। এই সুভাষিতাবলীতে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে ঔদার্যের এক মহান নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যা নীচে দেওয়া হল:
“অয়ম্ বন্ধুঃ পরোবেতি গণনা লঘুচেতসাম পুংসামুদার চিত্তনাম বসুধৈব কুটুম্বকম” (উদারাঃ, ৪৯৮)
বল্লবদেব এই শ্লোকটিকে ঔদার্য্য-প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রেখেছেন (হাস্যকর ভাবে কৃপণদের পরে)। বল্লবদেব আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন যে, এই শ্লোকের রচনাকার হলেন কাশ্মীরের অষ্টম শতকের কবি উদভাত ভট্ট, যিনি কাশ্মীরি কাব্যতত্ত্বের ধারায় দিকনির্দেশকারী ছিলেন; যে ধারা শুরু হয়েছিল ভামহের হাতে এবং পরিণতি লাভ করেছিল মাম্মতার হাতে।
এখন আমাদের দেখা দরকার, কোথায় ও কোন প্রেক্ষিতে উদভাত এই শ্লোকের ব্যবহার করেছেন। উদভাত ভট্টের প্রধান তিনটি রচনায় ও তার অন্যান্য রচনাতেও এই শ্লোককে পাওয়া যাচ্ছে না। তার সমসাময়িকদের লেখা থেকে জানতে পারি যে, উদভাত ভামহের ওপর ভামহ-বিবরণ রচনা করেন। এছাড়াও লেখেন কুমারসম্ভব কাব্য ও কাব্যলংকার-সার-সংগ্রহ, যা কাব্যতত্ত্বের উপর এক উল্লেখযোগ্য রচনা। এগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি হারিয়ে গেছে - প্রথমটি মনে হয় মাম্মতার দিকনির্দেশক রচনার পরে আর ব্যবহৃত হয়নি, এবং কুমারসম্ভব সম্ভবত একই নামের সংস্কৃত সাহিত্যের সম্রাট কালিদাসের কুমারসম্ভবের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে গেছে। অবশ্য, উদভাত ভট্টের কাব্যলংকার-সার-সংগ্রহ এখনো পাওয়া যাচ্ছে ও আরো কিছু রচনা, যার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে অন্যান্য লেখকদের লেখায়, যেমন, মহাপন্ডিত অভিনবগুপ্তের শিক্ষক ইন্দুরাজার লেখা লঘুবৃত্তিতে বা বল্লবদেবের সুভাষিতবলীতে, যেখানে উদভাতের তিনটি কবিতা স্থান পেয়েছে, যেখান থেকেই আমরা তার নাম পাই।
কাজেই, এটা খুবই সম্ভব যে, উদভাত কিছু রচনায় বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি ব্যবহার করেছিলেন, যা পরে লুপ্ত হয়ে গেছে। তবে, শ্লোকের ব্যবহারের প্রেক্ষিতটা আমরা জানতে পারছি না। তবে তিনি অবশ্যই এই শ্লোকের প্রকৃত রচনাকার নন। কারণ, তার হাজার বছর আগেই বিষ্ণুশর্মা পঞ্চতন্ত্রে তা লিখেছেন।
কাব্যতত্ত্ব, বিক্রমাদিত্য ও রাজা ভোজের সঙ্গেই অন্য আরেকটি নাম আমাদের সামনে চলে আসে। তিনি বিক্রমাদিত্যের ভবঘুরে অগ্রজ ভাই ভর্তহরি। ভর্তহরির তিনটি বিখ্যাত গ্রন্থ, প্রতিটিই একশত শ্লোকের - নীতিশতকম্, বৈরাগ্যশতকম্ এবং শৃঙ্গারশতকম্। যদিও এই শতক-গ্রন্থগুলোতে ঐ বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের উল্লেখ পাই না। তবে মার্কসিস্ট ঐতিহাসিক ডি. ডি. কোশাম্বি সম্পাদিত একটি গ্রন্থেই শুধু ঐ শ্লোকের উল্লেখ পাই। [ভর্তহরি-বিরচিত শতকত্রয়াদি সুভাষিত-সমগ্র, ডি. ডি. কোশাম্বি (১৯৪৮)]। অবশ্য ভর্তহরির শতকত্রয়ের বিভিন্ন সংকলনগ্রন্থের মধ্যে ঐ শ্লোকের অনুপস্থিতি দেখে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, কোশাম্বির সম্পাদিত গ্রন্থের উৎস শুধুমাত্র একটিই মাত্র উৎস যার থেকে এই উল্লেখ তিনি করেছেন। তাছাড়া, এই শ্লোকটি যেহেতু পূর্বেকার গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত হয়েছে, তাই ভর্তহরি এই শ্লোকের প্রকৃত রচনাকার নন।
উপনিষদে বসুধৈব কুটুম্বকম
এতোক্ষণ আমরা পর্যালোচনা করেছি হিতোপদেশ, পঞ্চতন্ত্র, কৌটিল্য ও ভর্তহরির নীতিবচনের সংকলনগ্রন্থসমূহ, বিক্রম-চরিতের অন্ধ্র ও জৈন সংকলনগুলি, বল্লবদেবের এনসাইক্লোপেডিক সংকলনগ্রন্থ এবং তার মাধ্যমে প্রাপ্ত রচনা। এগুলির মধ্যে একটাতেও কোনো একজন লেখকও বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের প্রকৃত রচনাকার হিসেবে দাবী করেননি। প্রত্যেকটি উদাহরণ ক্ষেত্রেই, ‘এ রকম বলা হয়’ - এভাবেই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি ব্যবহৃত হয়েছে।
কিম্তু, এক ও একমাত্র ব্যতিক্রমী হিসাবে স্বাভাবিক, অন্তর্নিহিত ও মূলভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য হিসেবে এই শ্লোকটিকে দেখা গেছে যে মূললেখাতে, তার কথাই এবার শেষে আমরা পর্যালোচনা করব।
ব্রহ্মসূত্রের বিখ্যাত ভাষ্য শ্রীভাষ্যমের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সপ্তম অধিকরণে ভাষ্যকার আচার্য্য রামানুজ শৈব-মাতাদের কাপালা, কালামুখ ও পাশুপত দার্শনিক ধারার সমালোচনা করেছেন তার ভাষ্যের ছত্রিশতম সূত্রে। যেখানে তিনি তার যুক্তির স্বপক্ষে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত উপনিষদ – মহোপনিষদের (একো হা বৈ নারায়ণা অসিন্নব্রহ্ম নেশনাহ … সা একাকী ন রমতে” ম.উ. ১.১) প্রথম শ্লোক উল্লেখ করেছেন। এখন, যদিও এই উপনিষদ খুব বেশি প্রচলিত নয়, তথাপি এর প্রামাণিকতা ও গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কারণ, আমরা দেখেছি, অনেক প্রাচীন বেদান্ত-বিশারদ এই মহোপনিষদের কথা উল্লেখ করেছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পুরুষ-নির্ণয়ে যমুনাচার্য, তত্ত্ব-নির্ণয়ে নারায়ণাচার্য এবং ভগবদগীতার ভাষ্যে যাদবপ্রকাশ।
বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকেরই একটি পরিবর্তিত রূপ পাই মহোপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের বাহাত্তরতম শ্লোকে। এখানে, ‘অয়ম্ নিজঃ পরোবেতি’র পরিবর্তে শ্লোকে পাই ‘অয়ম্ বন্ধুরায়ম নেতি’ (ইনি একজন বন্ধু, অন্যজন বন্ধু নন), অনুষ্টুপের বাকি অংশ একই আছে।
এখানে মহোপনিষদে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের সামগ্রিক অর্থ-ব্যঞ্জনা তথা প্রেক্ষিত বুঝতে ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৭০ - ৭৩ থেকে শ্লোকগুলি উল্লেখিত হলো:
উদারঃ পেশলাচারঃ সর্বাচারানুবৃত্তিমান
অন্তঃ সঙ্গ-পরিত্যাগী বহিঃ সংভারবনিব।
অন্তবৈরাগ্যমাদায় বহিরাশোন্মুখোহিতঃ
অয়ং বন্ধুরয়ং নেতি গণনা লঘুচেতসাং
উদারচরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম
ভাবাভাব বিনির্মুক্তং জরামরণবর্জিতং
প্রশান্ত কলনারভ্যং নীরাগং পদমাশ্রয়
এষা ব্রাহ্মীস্থিতিঃ সচ্ছা নিষ্কামা বিগতাময়া
আদায় বিহরন্নেবং সংকটেষু ন মুহ্যতি।। (মহোপনিষদ ৬.৭০-৭৩)
ওপরের শ্লোকগুলি আধ্যাত্মিক জগতে ব্রাহ্মীস্থিতি-প্রাপ্ত মহান ব্যক্তিদের লক্ষণাদি ও আচরণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
“(ব্রাহ্মীস্থিতি-প্রাপ্ত ব্যক্তি সর্বদাই উদার, ব্যবহারে পরিশীলিত, সামাজিক আদর্শযুক্ত এবং সমস্ত রকমের আসক্তিমুক্ত। ব্যবহারিক দিক থেকে অন্যান্যদের মতোই জাগতিক সাংসারিক কর্তব্যকর্ম করলেও, তারা মনের দিক থেকে আসক্তিহীন। ক্ষুদ্রমনা সাংসারিক লোকেরা যদিও ‘এ আমার আপন, ও আমার আপন নয়’ বলে, কিম্তু ব্রাহ্মীস্থিতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা উদার মনের হন এবং সারা পৃথিবীর সবাইকে আত্মীয় ভাবেন। তারা জাগতিক দুঃখ-কষ্ট, জরা-ব্যাধি-মৃত্যু থেকে মুক্তি পান। কোনো ধরনের আসক্তির বশীভূত তারা হন না। এই ভাবে যারা ব্রাহ্মীস্থিতি পান, তারা সর্বশুদ্ধ, তারা সমস্ত ধরনের আকাঙ্ক্ষা ও দুঃখ ভোগের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এই শুদ্ধগুণের অধিকারী হয়ে আসক্তিহীন, ক্লেশমুক্ত হয়ে তারা জগতের সর্বত্র বিচরণ করেন।“
কাজেই শ্লোকগুলি মহোপনিষদে কোন পরামর্শ, সুপারিশ বা আদর্শ বা সমাজের লক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি; ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতার বাইরে এই শ্লোকের কোন ব্যবহারযোগ্যতা নেই। বরঞ্চ, ব্রহ্মবেত্তাদের চরম প্রাপ্তির নিদর্শন হিসেবেই এইসব শ্লোকের উল্লেখ করা হয়েছে।
উপসংহার
আমরা এতোক্ষন সংস্কৃত সাহিত্যের বনরাজির মধ্যে দিয়ে যেন এক অভিযান করলাম, যাতে করে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটির উৎস কি, তার নিহিতার্থ কি, কোন প্রেক্ষাপটে প্রাচীন আচার্যরা এই শ্লোক উল্লেখ করেছেন, এবং আদৌ তারা এই শ্লোককে নিঃশর্ত সর্বজনীন ভাতৃত্ববোধক আদর্শ বা রাষ্ট্রনীতি হিসেবে ব্যবহার করতে বলেছেন কি না - এসবের উত্তর খুঁজলাম। এছাড়াও, হিন্দু-ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালে এই শ্লোকের উৎস ও তার প্রসার আমরা পর্যালোচনা করলাম।
১. মহোপনিষদ (৬.৭২) এই শ্লোককে ব্যবহার করেছে এক ব্যক্তি-মানুষের আধ্যাত্মিক জগতে চরম শিখরে ব্রাহ্মীস্থিতির লক্ষণ হিসাবে। আমরা আগেই যেমন দেখেছি, মহোপনিষদই একমাত্র টেক্সট যেখানে বসুধৈব কুটুম্বকম সেই মূল টেক্সটের মূলভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া, অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই এই শ্লোককে মূলভাবের বাইরের অংশ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে। সেইজন্য, আমরা খুব যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, এই মহোপনিষদই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের প্রকৃত উৎস।
প্রকৃতপক্ষে, প্রকৃতিগতভাবেই উপনিষদকগণ তাদের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তাই ব্যক্ত করেছেন, যদি না তারা বেদসমূহ বা অন্যান্য উপনিষদ থেকে কোন থিম/ভাবনা বা উক্তি করে থাকেন। কিম্তু কখনোই বেদ-উপনিষদের বাইরের অন্য কোন উৎস তারা ব্যবহার করেন নি। যদিও উল্টো ঘটনা ঘটেছে - উপনিষদের বিভিন্ন উক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া, কোনো একটি উপনিষদ কোন জনপ্রিয় শ্লোককে তার অন্তর্নিহিত মূলভাবের অঙ্গীভূত করেছে - তা অকল্পনীয়। প্রকৃতপক্ষে, এই মহোপনিষদ, যেখানে এই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি ও অন্যান্য প্রাচীন টেক্সটের উক্তি আছে, যা পঞ্চতন্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে, তা এই উপনিষদের এই অংশের প্রাচীনতাই প্রমাণ করে।
তাছাড়া, অনেক বৈদান্তিক ভাষ্যকারও, বিশেষ করে বৈষ্ণব-ভাষ্যকারদের তাদের ভাষ্যে এই শ্লোকের ব্যবহার জনপ্রিয়তাকেই বোঝায়: যেমন, রামানুচার্যের (~ ১০৮০ সাধারণাব্দ) শ্রীভাষ্যমে (২.৭.৩৬), যমুনাচার্যের পুরুষ-নির্ণয়ে, নারায়ণাচার্যের তত্ত্ব-নির্ণয়ে, যাদবপ্রকাশের ভগবদগীতার ভাষ্যে, এবং শংকরানন্দের (~ ১৩০০ সাধারণাব্দ) মহোপনিষদের উপর এক সম্পূর্ণ ভাষ্যে।
মানসতরঙ্গিণীর আচার্য্য মত প্রকাশ করেছেন, মহোপনিষদের কিছু অংশ সম্ভবত মহাভারতের পূর্বের, যা শান্তিপর্বের নারায়নীয় উপপর্বে মহোপনিষদের নাম একবার নয়, দু’বার উল্লেখের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে:
মহোপনিষদং মন্ত্রম অধীয়ানান স্বরান্বিতম পঞ্চোপনিষদের মন্ত্রের মনসা ধ্যায়তঃ শুচি।।
এবং
ইদং মহোপনিষদং চতুর্বেদ-সমন্বিতম সাংখ্যযোগকৃতং তেন পঞ্চরাত্রানুশব্দিতম।। (নারায়নীয়, শান্তিপর্ব, মহাভারত)
এটা সম্ভব যে, মন্ত্রমার্গ-পঞ্চরাত্রর পূর্বে বৈষ্ণবদের নিশ্চয়ই একটা মহোপনিষদ ছিল, যা একই নামে মূল টেক্সট হিসেবে আজও পাওয়া যাচ্ছে। যার থেকে বলা যায়, ঐ মহোপনিষদের মূলটেক্সটে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি ছিল। তার অর্থ হলো, এই ধরনের মূল মহোপনিষদ অবশ্যই ছিল এবং জনপ্রিয় হওয়ার পর তারা তা তাদের লেখায় উল্লেখ করেছিলেন।
২. পঞ্চতন্ত্রে (৫.৩.৩৭) আছে, লেখক ঘোষিত এক বোকা-বিদ্বান এই শ্লোকটি ঘোষণা করেছে, যে নিজের বোকামির জন্য নিহত হয়েছে, যা বাস্তব জ্ঞানের অভাব প্রমাণ করে। এই সাহিত্য কর্মটি নিশ্চিতভাবেই মৌর্য যুগের শেষের দিকে রচিত হয়েছিল। সেই সময় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, বৈদেশিক আক্রমণের সঙ্গে আস্তে আস্তে ছোট ছোট রাজ্যও গড়ে উঠছে। সামাজিক ক্ষেত্রে, জৈন, বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব ধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এইরকম সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ও শান্তিকামী ভাবধারার বিপরীতে বিষ্ণশর্মা নিশ্চয়ই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের অর্বাচীন ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন, যেখানে ঐ বাণীদাতা বোকা লোক নিজের মূর্খতার জন্য নিজেই নিহত হয়েছিল।
৩. হিতোপদেশ (১.৩.৭১) পঞ্চতন্ত্র থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল এবং দুটো ব্যাঙ্গার্থক গল্পে দেখিয়েছিল যেভাবে সাবভারসনিষ্টরা এর ব্যবহার করে ও সহজবিশ্বাসীরা তাদের খপ্পরে পড়ে। হিতোপদেশ প্রকৃত বীরনায়কদের প্রশংসাও করেছিল, যারা ঐ শ্লোকের দ্বারা প্রভাবিত হয় নি।
এই হিতোপদেশের রচনা কিছু পূর্বেই, লক্ষ করা যায়, পঞ্চতন্ত্রের দক্ষিণ-ভারতীয় সংস্করণ হিতোপদেশের ঐ রকম বার্তাই দিয়েছে। সেই ধরনের বার্তার ছবিই আমরা পাই মহাবলীপুরমের মন্দির গাত্রে খোদাই চিত্রে, যার চিত্র এই নিবন্ধের শেষে দেয়া হয়েছে।
৪. কৌটিল্যের সংগ্রহগুলিতেও, শুধুমাত্র দুটো ক্ষুদ্র সংগ্রহগ্রন্থ ছাড়া, এই শ্লোকের উল্লেখ নেই। এছাড়াও, কৌটিল্যিয় ভাবধারা বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের তথাকথিত ভাবধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
৫. অষ্টম শতকের উদভাত ভট্ট তার কাব্যকর্মে যদিও এই শ্লোকের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তার প্রেক্ষিতটা আমরা জানি না।
৬. সুভাষিতবলীতে (উদারা. ৪৯৮) এই শ্লোকটি মহানুভবতার নিদর্শন হিসেবে কাব্যের উৎকর্ষের জন্য সুভাষিত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এটাও বলা দরকার যে, সাধারণ জনসমাজ ততদিনে এই শ্লোকের প্রকৃত উৎস কি, তা ভুলে গেছে। যেমন দেখা যাচ্ছে, পল্লবদেব ভুলভাবে এই শ্লোকের রচনাকার হিসেবে অষ্টম শতকের কাশ্মীরি কবি উদভাত ভট্টের নাম করেছেন। তিনি, এমন কি জানতেন না যে, জনপ্রিয় পঞ্চতন্ত্রেই এই শ্লোকের উল্লেখ আছে।
৭. বিক্রম-চরিতের (অন্ধ্র ৩.১, জৈন ১৭.৩, শুভশীল ৬.২৭০) তিনটি সংস্করণেই এই শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে উদারতা ও ন্যায়ের প্রেক্ষিতে; কিন্তু, সর্বজনীন ভাতৃত্ববোধের আদর্শ হিসেবে নয়।
অতএব, আমরা নিশ্চিত ভাবেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, মহোপনিষদে এই শ্লোক যে প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়েছে এবং পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ ও বিক্রম-চরিতে যেভাবে এই শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে, তা উপেক্ষা করে আজকের রাজনীতিকরা ও নীতিনির্ধারকরা প্রাচীন উদারবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের তথাকথিত উত্তরসূরি হিসেবে যেভাবে এই শ্লোক ব্যবহার করেন, তাতে বলা যায় যে, বসুধৈব কুটুম্বকম এক ছলনার বেশি কিছু নয়। যখন প্রাচীন ভারতের স্বপ্নালু সর্বজনীন ভাতৃত্ববোধক আদর্শের হিন্দু-সংস্করণ হিসেবে আজকের পণ্ডিতরা উল্লেখ করেন, তাতে বলাই যায়, এই শ্লোক এক ছলনা মাত্র। এছাড়াও, ধর্মপ্রচারকদের কাছ থেকে আমরা যখন শুনি, জনগণের কাছে বসুধৈব কুটুম্বকমের নীতি-আদর্শকে অনুসরণ করার জন্য প্রচার করতে, তখন এটা অবশ্যই বলতে হবে, আধ্যাত্মিকতার প্রেক্ষিতেও এই বসুধৈব কুটুম্বকম এক ছলনা মাত্র!
(শেষ)
অনুবাদক: ড. সুজিৎ রায়
@ Dr. Sujit Roy
27.06.24
https://drive.google.com/file/d/1cfjIqGX2RI23VDf3sqSzxrL2yYWuP4WV/view?usp=drivesdk
Thanking you all,
Dr. Sujit Roy
11.05.23
বিগত কয়েক বছরে আমার লিখিত প্রবন্ধগুলিকে এক জায়গায় করে ই-বুক প্রকাশ করলাম। তারই লিংক দিলাম। ডাউনলোড করে পড়ুন ও মূল্যবান মতামত দিন।
https://drive.google.com/file/d/1VEwZDun-9BlzJuCb82N2ONK0GlKvhko8/view?usp=drivesdk
ধন্যবাদ,
ড. সুজিৎ রায়
02.05.23
The eBook of my book on research studies titled "Research: Structure, Process and Behaviour' has been published.
Regards,
Dr. Sujit Roy
This is a reference book on research studies. Here research studies is viewed as a discipline and I have coined the term #Researchology for research studies as a discipline (Gobeshona Shastra/Anusandhan Shastra in Sanskrit).
The book is for students, research scholars and teachers as well as for professionals who are engaged in research works in any field of studies as the book has covered almost all areas of research in a holistic manner.
The book is published by Bani Bharati Publishers, Kolkata and priced @ ₹575. Interested persons may order the book through the website of the publishers or may enquire to the E-mail:
banibharatipublishers@gmail.com
The book is also available in E-commerce sites like Amazon, Flipkart etc.
Research: Structure, Process and Behaviour https://amzn.eu/d/6qZJil4
Dr. Sujit Roy
From 24 February 2022 with the invasion of Russia on Ukraine began the Russo-Ukraine War, causing Europe's largest refugee crisis since World War II as well as exposing the fragility of so-called ‘rule-based’ world order.
It is a telling reality that the world politics is a function of geo-economics and national security. From Russian view-point, it is not an invasion but “special military operation” inside Ukraine to meet it's geo-economic as well as national interest.
From the day one, India has adopted a position of strategic neutrality on Russo-Ukraine War and urged both sides to “return to diplomacy and end to fight” as reiterated by S Jaishankar, the Foreign Minister, in Raisina Dialogue conference on geo-politics and geo-economics.
Now the moot point: how far India’s strategic neutrality can be explained as a paradigm shift in foreign policy?
After independence, India had adopted a position of so-called neutrality in the form of Non-Alignment Movement (NAM) in the Cold War era under the leadership of Pt. Jawaharlal Nehru. But the position pursued by Nehru was more of ideological than strategic in nature. Nehru’s ‘non-alignment’ position was so personalistic in approach that the national interest was compromised at the altar of international figurehead aspirations.
Non-alignment was not a neutral position at all, but a balancing act in post-WW II Cold War era. Non-alignment was a kind of passive neutrality under a compulsive situation. This position was first jolted by the India-China War in 1961 and finally by the India-Pakistan War in 1971 when the Soviet Russia stood by India in the face of the threat of USA to India by taking side with Pakistan. So the neutrality of NAM was so vague and hollow that India had to tilt her position towards the USSR post-1971 War.
Now, under a multi-polar world in the 21st century India has adopted a position of neutrality for the first time which has been strategic in nature, bereft of any ideological hangover of the past position.
Despite the veiled threat of the USA, India stood on her ground firmly in all respects and continued steadfastly with her own versions of international relationships. Right from the imports of S-400 missile defence system to imports of crude oil from Russia, India has shown a new ‘Avatar’ of Indian foreign policy. The new assertiveness in foreign policy has been mistakenly criticised as ‘arrogance’ by the frustrated politicians of India.
For the first time in the history of Indian diplomacy, India has shown not only a strategic stoicism in facing criticism but also repudiated prejudiced criticism in a stoic manner. Fingers pointed at India by the countries have been countered by India with the same coin of “double-standard” policy adopted by those countries in a befitting way.
The Russo-Ukraine War has provided a critical ground to India to test her position in the present day volatile international politics. The strategic neutral position adopted by India has been so forceful that no country has been able to counter India’s viewpoints. India has now been claiming a “right to equal partnership” in geo-political relationship in global forum which has been commensurate to her emerging position as an economic powerhouse.
Under the strategic leadership of Narendra Modi, India is now pursuing a path of assertion in international relationship through tactical maneuvering and leveraging of her geo-strategic position. That is why the big powers, be it USA, EU, UK, Russia, Japan, and Australia, have been trying to engage with India through different types of alliances. The template of strategic neutrality in international politics adopted by India has been a paradigm shift in Indian diplomacy.
@ Sujit Roy
05.06.2022
Here is the link of eBook of my book on research studies titled "Research: Structure, Process and Behaviour". Research eBook Rega...