ভারতীয় সভ্যতায় শিক্ষা ব্যবস্থা

১৯শে মার্চ, ২০২০ তারিখে 'বঙ্গদেশ' নেট-ম্যাগাজিনে আমার অনূদিত নিচের নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। বরিষ্ট আইপিএস এম নাগেশ্বর রাওয়ের মূল নিবন্ধটি Outlook ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল।

"ভারতীয় সভ্যতার সমস্যাগুলোর মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থাই সবথেকে দুঃখজনক"


এম নাগেশ্বর রাও


'নিজের ধর্ম ও ভাষা জানা এক ব্যক্তিই অপরকে সম্মান দিতে জানে, যা সমাজে সংহতি ও একতা আনতে পারে'


১৯৫০, ২৬ জানুয়ারিতে যখন আমাদের সংবিধান কার্যকরী হলো, তখন সেই সংবিধানে শব্দসংখ্যা ছিল ৮০ হাজার। আশ্চর্যজনকভাবে, তখন ২৫ নং অনুচ্ছেদে ভাব উল্লেখ ছাড়া 'সেক্যুলার' শব্দটি অনুপস্থিত ছিল। তাই, ১ নং অনুচ্ছেদ এবং ২৫ থেকে ৩০ নং পর্যন্ত অনুচ্ছেদগুলি একসঙ্গে, যা মূল সংবিধানের ভূষণস্বরূপ, আমাদের দেশের ধর্মীয় চরিত্রকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের সংবিধান সকল ধর্মমতকে স্বীকৃতি তথা মর্যাদা দিয়েছে।


অবশ্য, আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষা-ব্যবস্থা আমাদেরকে ধর্মবোধহীন এবং ঐতিহ্য-বিহীন করে আত্মদোষ-পরায়ণ ব্যক্তি হিসাবে গড়ে তুলছে। এর সঙ্গে আছে বিভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থার, বিশেষতঃ ২৮ নং অনুচ্ছেদের ক্ষতিকর প্রভাব, যা হিন্দুদের উপরেই বেশি করে পড়েছে; কিন্তু, ৩০ নং অনুচ্ছেদ সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


তাই, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-বিযুক্ততার বিপদ থেকে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সব নাগরিককেই রক্ষা করার জন্য লোকসভায় ১৯৯৫ সালে সৈয়দ শাহাবুদ্দিন ৩৬ নং প্রাইভেট মেম্বারস বিল উত্থাপন করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ৩০ নং অনুচ্ছেদের পরিসর বাড়ানো। সেই বিলে ওনার অপ্রতিরোধ্য যুক্তি ছিল: "সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু সব ধরনের গোষ্ঠীমানুষেরই ন্যায্য অধিকার আছে, তাদের পরম্পরাগত ঐতিহ্য ও ভাষাকে রক্ষা করে পরবর্তী প্রজন্মকে সেই ভাবধারায় পরিশীলিত করার।"


শ্রদ্ধেয় ধর্মপালজী তার বিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থ "দি বিউটিফুল ট্রি: ইন্ডিজিনাস ইন্ডিয়ান এডুকেশন ইন দি এইটিনথ্  সেঞ্চুরি", যা ব্রিটিশ আধিকারিকদের বিভিন্ন প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল, তাতে দেখিয়েছেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বেই নিম্ন জাতির মানুষসহ সকল জাতির মানুষের জন্য এক ধরনের কার্যকারী শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল। তিনি বলেছেন, "পাঠশালা ও মাদ্রাসাগুলি স্থানীয়স্তরে তো বটেই, এমনকি সমাজের উচ্চ স্তরেও, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মর্যাদাসহ ভারতীয়দের যথাযথভাবে অংশগ্রহণের উপযুক্ত করে গড়ে তুলত।"


আমরা সবাই জানি,  মাত্র ২০০ বছরের কম সময়ের মধ্যেই ব্রিটিশরা এমনভাবে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছিল যার ফলে ১৭০০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে আমাদের অংশীদারিত্ব ২৪.৪ শতাংশ থেকে ১৯৫০ সালে তা নেমে এলো মাত্র ৪.২ শতাংশে, এবং বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদনে ১৭৫০ সালের ২৫ শতাংশ থেকে নেমে দাঁড়ালো ১৯০০ সালে মাত্র ২ শতাংশে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এতো কম সময়ে ব্রিটিশরা কিভাবে এমন ভয়াবহভাবে ভারতের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারল? তার উত্তর খুবই সহজ! তারা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে, যা পরম্পরাগত ও বৃত্তিমূলকভাবে সংপৃক্ত ছিল, তার পুরোপুরি মূলোৎপাটন করেছিল এবং ভারতকে বিশ্বের অন্যতম গরিব দেশে পরিণত করেছিল।


মহাত্মা গান্ধী তার অননুকরণীয় ভঙ্গিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য ব্রিটিশকে দায়ী করে বলেছিলেন, "তারা মাটি খুঁড়ে গাছের মূলকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ও তাকে সেরকমই রেখে দিয়েছিল, এবং ফলে সেই সুন্দর গাছটি মরে গেল।" তথাপি, স্বাধীনোত্তরকালে আমরা তার থেকে কোনো শিক্ষা নিলাম না যে, সভ্যতার ঐতিহ্য সম্পৃক্ত থাকা শিক্ষাব্যবস্থাই স্থায়ী সমৃদ্ধির প্রাথমিক শর্ত।


গবেষণামূলক ভাবে এটা বলা যায়, কঠোর পরিশ্রম ও উদ্যোগী মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ থাকলেও কোনো দেশ, যদি তার সভ্যতার পরম্পরার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকে, তা কখনোই টেকসই সমৃদ্ধশালী হয়ে উড়তে পারে না। ইউরোপ তার খ্রিস্টীয় সভ্যতার দ্বারাই সমৃদ্ধির দিকে চালিত হয়েছিল এবং তার সাম্প্রতিক অবনতির জন্য দায়ী হলো সভ্যতার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত খ্রিষ্টীয় রক্ষণশীলতার দেশ। জাপান গভীরভাবে ঐতিহ্যবাহী দেশ, যা তাকে পারমানবিক আক্রমণের জন্য ধ্বংস হওয়ার পরেও পুনরুত্থানের পথে সাহায্য করেছে। ভূতপূর্ব সুপার পাওয়ার কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়া, যা তার নিজস্ব ইস্টার্ন অর্থোডক্সির পরম্পরাকে ধ্বংস করেছিল, তা মাত্র ৭০ বছরের মধ্যেই নিজেই ধ্বংস হয়ে গেল। তাই, সভ্যতার পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তাকে বুঝে আজকের কমিউনিস্ট চিন তার মান্দারিন ভাষা ও কনফুসিয়বাদকে তুলে ধরার উপর জোর দিচ্ছে।


কিন্তু, ভারত এখনো বিভ্রান্ত। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যেন 'না এখানে, না ওখানে'! আমরা আমাদের সভ্যতার সমস্ত ধরনের পরম্পরাগত জ্ঞান-বিদ্যাকে নির্বাসিত করেছি এবং 'ঋকবেদ', যা পৃথিবীর প্রাচীনতম শাস্ত্রীয় জ্ঞান, তা-সহ সমস্ত প্রাচীন টেক্সট আমরা পরিত্যাগ করেছি। আমরা অভাবনীয় সমৃদ্ধ ভাষিক ঐতিহ্য ও অসংখ্য ভাষাকে পরিহার করে ইংরেজিকে তুলে ধরেছি। ভারতীয় ঐতিহ্যের মূলসূত্রহীন আজকের শিক্ষা নীতিগুলি মূলতঃ ব্রিটিশদের মেকলীয় নীতিরই ধারাবাহিকতা। তার জন্য, আনন্দ কেনটিশ কুমারস্বামীকে উদ্ধৃত করে বলা যায়, "ভারতের সকল সমস্যার মধ্যে সবথেকে জটিল ও দুঃখজনক সমস্যা হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা।" আমার নিজের এক আত্মীয়, যিনি আমেরিকায় থাকেন, একবার বলেছিলেন, তিনি যতবার ভারতে আসেন ততোবারই যেন বেশি করে পশ্চিমকে ভারতে দেখতে পান।


এটা সত্য যে, সংবিধানের ২৮ নং অনুচ্ছেদ সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষাদান নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু, আমাদের পরম্পরাগত জ্ঞান-বিদ্যা ও প্রাচীন গ্রন্থসমূহ শিক্ষা এবং ধর্মীয় রীতির পরিবর্তে তুলনামূলক ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে সংবিধান নিষেধ করেনি। তাছাড়াও, সংবিধান সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসহ সমস্ত সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু অসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষাকে ব্রাত্য করেনি। তথাপি, আমরা নিজেরাই তা ব্রাত্য করেছি এবং পরিবর্তে, যা কিছু বিদেশি তাই আমরা শিখেছি। স্বাধীনোত্তর কালে আমাদের প্রাচীন সভ্যতাকে জাতীয়ভাবে উপেক্ষা করাকে অনেকটা তুলনা করা যায় যখন কোন একজন নতুন 'ধর্মান্তরিত' ব্যক্তি তার পুরনো পাগান অতীতকে যেভাবে প্রতিহিংসামূলক ভাবে অস্বীকার করে!


পুরুষানুক্রমিক ভাবে আমরা তিন ধরনের ঋণ- দেবঋণ, ঋষিঋণ ও পিতৃঋণ, যাদের কাছে পরম্পরাগত জ্ঞানের জন্য আমরা সভ্যতাগত ভাবে ঋণী, তা স্বীকার করতে আমরা দায়বদ্ধ। তার অর্থই হলো, পরম্পরাগত ভাবে আমরা যা পেয়েছি, সেগুলিকে অবিকৃতভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এই পরম্পরাকে ধ্বংস করার কোন অধিকার আমাদের নেই; কারণ, সেগুলোকে আমরা তৈরি করিনি। অতএব, আমরা অবশ্যই পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের সভ্যতাগত জ্ঞান শিক্ষা দেব এবং দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষার মূলসূত্রগুলি বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা দেব।


ভারত বহুভাষী এক দেশ এবং হাজার হাজার বছর ধরেই ভারতীয়রা বহুভাষী বা বহুভাষার পরিবেশে বাসরত। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের আগে, আজকের রাজ্য-সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষেরা দুই ভাষাই জানত।  ১৯৫৬ সালের পরবর্তীতে, দুই প্রতিবেশী রাজ্যের বাসিন্দাদের মধ্যে গড়ে ওঠা ভাষাভিত্তিক দেওয়ালকে আমাদের অতিক্রম করতে হবে। এছাড়া, উর্দু বাদে বাকি অন্যান্য ভারতীয় ভাষাগুলি ইংরেজির দাপটে ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। ভারতীয় ভাষাগুলি মৃত হলে ভারতীয় সভ্যতাও বাঁচতে পারবে না। কারণ, আমাদের ভাষা ও সভ্যতা একই মুদ্রার দুই পিঠ।


অতএব, সংবিধানের ৩৫০এ অনুচ্ছেদ ও আরটিই এ্যাক্টের ২৯ সেকশন অনুযায়ী দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষাকে পড়াশোনার মাধ্যম করতে হবে। যারা দশম বা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষাতে পড়াশোনা করেছে, তাদেরকে সিভিল সার্ভিসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়াসহ বিভিন্ন বৃত্তি, সুদ-বিহীন শিক্ষাঋণ ইত্যাদি সুবিধা দিতে হবে।


এছাড়াও, বহুভাষিকতাকে শক্তিশালী করতে মাতৃভাষা ছাড়াও সকল ছাত্রকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অন্তত অন্য একটি ভারতীয় ভাষাকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে হবে। অবশ্য, ছাত্রদের পার্শ্ববর্তী রাজ্যের ভাষাসহ সংস্কৃত, হিন্দি ইত্যাদি ভাষা থেকে যে কোনো একটা ভাষাকে পছন্দ করার সুযোগ দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, তামিলনাড়ুর ছাত্রদের তেলেগু, কন্নড়, মালায়ালাম, সংস্কৃত ও হিন্দি থেকে যে কোনো একটি ভাষাকে পছন্দ করার সুযোগ দিতে হবে।


আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতাই হল আমাদের পরিচিতি-সত্তা। এই সত্তা হারানো মানে সবকিছুই হারিয়ে ফেলা। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, ধার করা পরিচিতি দিয়ে সমৃদ্ধি আসতে পারে না। এটাও সত্য যে, একজন শিল্পীই অন্য একজন শিল্পীর কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন। সেই ভাবেই, একজন ব্যক্তি যিনি নিজের ধর্ম ও ভাষাকে জানেন তিনি অপরের ধর্ম ও ভাষাকে সম্মান দিতে পারেন, এবং সেটাই শুধুমাত্র একটা দেশের ঐক্য, সংহতি ও সমৃদ্ধি আনতে পারে।


মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন ড. সুজিৎ রায়।


@ ড. সুজিৎ রায়

No comments:

Post a Comment

Research Structure, Process and Behaviour

Here is the link of eBook of my book on research studies titled "Research: Structure, Process and Behaviour".  Research eBook Rega...