এক দেশ, এক ভোটার তালিকা: ভারতে নির্বাচনী সংস্কারের এক রূপরেখা


ভারতে নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে 'বঙ্গদেশ' নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত আমার নিবন্ধ।
https://www.bangodesh.com/2020/08/an-article-by-sujit-roy-on-one-nation-one-voter-list/

সম্প্রতি ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর (পিএমও) ভারতের নির্বাচন আয়োগ (ইলেকশন কমিশন), আইন ও অন্যান্য কিছু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভারত-ব্যাপী একটিই অভিন্ন 'সাধারণ নির্বাচক তালিকা' (কমন ভোটার রোল) তৈরি করার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। এ ব্যাপারে ২০১৫ সালে আইন কমিশন তার ২৫৫-তম প্রতিবেদনে এবং ইলেকশন কমিশন ১৯৯৯ ও ২০০৪ সালে একই কথা বলেছিল। তাই এই প্রস্তাব একেবারেই নতুন কিছু নয়। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ভারতের এক সার্বিক নির্বাচনী সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করব, যাতে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে ভারতের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূল নায়ক মনে করতে পারেন।

সার্বভৌম সাধারণতান্ত্রিক ভারতে যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র তার মূলভিত্তি কি – ভারতের জনগণ, রাজ্যসমূহ, সংসদ না বিচারবিভাগ? অবশ্যই জনগণ/নাগরিকবৃন্দ। কারণ, ভারতীয় জনগণই এই রাষ্ট্র তথা নেশন তৈরি করেছে। তাই, ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতেই আছে, "আমরা, ভারতের জনগণ, …" অর্থাৎ 'ভারতের জনগণ'ই ভারত-রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।

সেই নাগরিকবৃন্দের প্রতিনিধিস্বরূপই স্থানীয়, রাজ্য ও জাতীয় স্তরের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা এই ভারতে গড়ে উঠেছে। সেখানে স্থানীয় স্তরের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুত্ব কি কম? সাধারণ মানুষের মনে কিন্তু এই ভুল ধারণা গড়ে উঠেছে যে, রাজ্য বা জাতীয় স্তরের নির্বাচন-ব্যবস্থা যেন সুয়োরানী, আর স্থানীয় স্তরের নির্বাচন-ব্যবস্থা যেন দুয়োরানী।

ভারতে তিন ধরনের নির্বাচনের মধ্যে জাতীয়স্তরে সংসদের লোকসভা ও রাজ্যসভার এবং রাজ্যস্তরের বিধানসভা ও বিধানপরিষদের (যে সব রাজ্যে বিধানপরিষদ আছে) নির্বাচনের দায়িত্বে আছে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয়স্তরের গ্রামীণ/নগর পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রশ্ন হলো, ভারতের পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে একীকৃত ও সমন্বিত (ইউনিফায়েড এ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড) করা যায় না কি, যাতে করে প্রভূত পরিমাণে একই ধরনের কাজের জন্য যতোটা সম্ভব সময়, শ্রম ও অর্থ-অপচয় রোধ করা যায়? বিশেষ করে, আধুনিক প্রযুক্তি-ব্যবস্থার মাধ্যমে যখন এইধরনের সমন্বিত নির্বাচন-ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতেই পারে।

প্রথমত, 'কমন ভোটার রোল' সেই পথে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। তার জন্য ভারতের সংবিধানের ২৪৩ কে এবং ২৪৩ জেডএ অনুচ্ছেদ দুটি শুধু সংশোধন না করে বরং ওই দুটি অনুচ্ছেদ বিলোপ করে সেখানে স্থানীয় স্তরের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সরাসরি ভারতের নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত করে সংবিধান সংশোধন করা দরকার। তবেই ভারতের জনগণ সবস্তরের নির্বাচনের ব্যাপারে যে রাষ্ট্র সমান গুরুত্ব দেয় তা অনুভব করতে পারবে। আজকের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্থানীয় গ্রামীণ/নগর পঞ্চায়েতগুলির ভূমিকা এতোটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তাদের নির্বাচন ব্যবস্থাও যতোদূর সম্ভব মুক্ত ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে করা দরকার, যা একমাত্র ভারতের নির্বাচন কমিশনই করতে পারে। তবে, ভবিষ্যতে 'জাতীয় নাগরিকপঞ্জি'কে যথাযথভাবে তৈরি করে সেটিকে এই এক ভোটার তালিকার ভিত্তিভূমি হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, স্থায়ী নির্বাচনী ক্যাডার। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের কোনো স্থায়ী ক্যাডার নেই। নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও অন্যান্য কর্মচারীদের সাময়িকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিশ্চিতভাবেই পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য সব আধিকারিকদের স্থায়ী ক্যাডার হিসাবে নিয়োগ করা অসম্ভব ও অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু অন্ততপক্ষে, রাজ্য নির্বাচনী আধিকারিক এবং জেলা নির্বাচনী আধিকারিকদের স্থায়ী নির্বাচনী ক্যাডার হিসাবে নিয়োগ দরকার। তাহলে নির্বাচনী প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা অনেকটাই সাধারণ মানুষ তথা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বেশি করে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। এর জন্য সংবিধান তথা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইনকে যথোপযুক্ত সংশোধন করা দরকার।

তৃতীয়ত, জাতীয় সিলেকশন কমিশন গঠন। এই আয়োগের সদস্য হতে পারেন তিনজন – ভারতের প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী/সবথেকে বড় বিরোধী দলের নেতা, এবং ভারতের প্রধান বিচারপতি। এই কমিশনই কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনার, সিবিআইয়ের নির্দেশক সিলেকশন করার মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, ক্যাগ, লোকপাল ইত্যাদি সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকদের মনোনয়ন করতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধন যথাসম্ভব জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে করা যেতেই পারে, যাতে সমস্ত ধরনের সাংবিধানিক মনোনয়ন বা সিলেকশন বিতর্কের উর্ধ্বে থাকে।

চতুর্থত, স্থানীয় স্তরে দলহীন নির্বাচনী-ব্যবস্থা। বর্তমানে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাবে স্থানীয় নির্বাচন হয়ে থাকে। কোনো কোনো রাজ্যে, যেমন বিহারে, কর্ণাটকে দলহীন নির্বাচন হয়। সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থাই সারা দেশে চালু করা উচিৎ। কারণ, আবহমানকালের ভারতীয় জীবনধারায় স্থানীয় স্তরে দলবিহীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাই স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সংবেদনশীল প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা বজায় রেখে ছিল। এছাড়াও, স্থানীয় স্তরে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সার্বিক নীতি-নির্ধারণের জায়গা নেই, যা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত। স্থানীয় স্তরের প্রতিনিধিরা মূলত সেই সব নীতিকে রূপায়ণ করার জন্যই নির্বাচিত হন, যেখানে দলীয় আনুগত্যের প্রশ্ন না-ওঠাই উচিত।

পঞ্চম ও শেষতঃ, কমন পোল বা এক নির্বাচন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয়। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্য ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে করা যায় কিনা, বা করা উচিৎ কিনা? সময়, শ্রম ও অর্থ-সম্পদের অযথা ব্যয় ও অপব্যয় রোধ করতে একই সঙ্গে নির্বাচন করা যেতে পারে। কারণ, এখন সারা ভারতেই সবসময় কোনো না কোনো ধরনের নির্বাচন লেগেই আছে। ভারত যেন সবসময়ই 'ইলেকশন মোডে' রয়েছে। ফলে, স্বাভাবিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা তথা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু 'এক দেশ, এক নির্বাচন' রাজনৈতিক ভাবে কতোটা গ্রহণযোগ্য হবে? সেই জন্য প্রস্তাব হচ্ছে, ‘এক দেশ, দুই নির্বাচন’, যেখানে জাতীয় তথা রাজ্য নির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচনের মধ্যে দুই থেকে তিন বছরের ব্যবধান থাকতে পারে। এর জন্য যথাসম্ভব ঐক্যমতের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আর, এই ব্যবস্থা ২০২৬ সালের ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরেই করা যেতে পারে; যার জন্য কোনো রাজনৈতিক দলেরই আপত্তি থাকার কথা নয়।

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে ধারাবাহিক ভাবে যথাসম্ভব সুষ্ঠ, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে বিভিন্ন নির্বাচন-পর্ব সম্পন্ন করার জন্য ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নহীন। ইভিএম ও ভিভিপ্যাটের সম্পূর্ণ সিঙ্ক্রোনাইজেশন এবং জিরো স্ট্যাটিস্টিকাল এরর প্রমাণ করে দিয়েছে ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের যথার্থতা। তাই ভবিষ্যতে নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই সমাজের জন্য মঙ্গল। একই ভাবে প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার করে 'এক দেশ, এক ভোটার তালিকা' তৈরি করে ভারতের নির্বাচনী সংস্কারের পথে এগিয়ে যাওয়া দরকার।

সব মিলিয়ে, সামনে ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছরের পূর্তিতে ভারতের ‘সার্বভৌম জনগণ’ যাতে আরো বেশি করে সার্বভৌমত্বের নির্যাস অনুভব করতে পারে তার জন্যই এক সার্বিক সমন্বিত নির্বাচনী সংস্কার এক অতি আবশ্যকতা।

@ সুজিৎ রায়
31.08.2020



No comments:

Post a Comment