বসুধৈব কুটুম্বকম: ছলনার আরেক নাম- পর্ব-৩: বিক্রম, কাব্যতত্ত্ব ও উপনিষদ
সর্বেশ কে তিওয়ানের নিবন্ধটির বাংলায় আমার অনূদিত তৃতীয় তথা শেষ পর্ব 'বঙ্গদেশ' নেট-ম্যাগাজিনে আজ প্রকাশিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক আদর্শ ও 'দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন' সমাজ নীতি যে এক নয়, তাই পুরো নিবন্ধের মূল বক্তব্য।
সর্বেশ কে তিওয়ানের নিবন্ধটির বাংলায় আমার অনূদিত তৃতীয় তথা শেষ পর্ব 'বঙ্গদেশ' নেট-ম্যাগাজিনে আজ প্রকাশিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক আদর্শ ও 'দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন' সমাজ নীতি যে এক নয়, তাই পুরো নিবন্ধের মূল বক্তব্য।
The Hoax Called Vasudhaiva Kutumbakam-3: Vikrama, Poetics and Upanishada
By Sarvesh K Tiwan
‘বসুধৈব কুটুম্বকম’: ছলনার আরেক নাম -৩ : বিক্রম, কাব্যতত্ত্ব ও উপনিষদ
- সর্বেশ কে তিওয়ান
অনুবাদক: ড. সুজিৎ রায়
আগের দুই পর্বে (১: হিতোপদেশ, ২: পঞ্চতন্ত্র ও চাণক্য) আমরা দেখেছি, বসুধৈব কুটুম্বকম নীতিবচনকে প্রাচীন নীতিশাস্ত্রগুলি কোন ভাবে দেখেছে। এই শেষ পর্বে, আমরা বাকি উৎসগুলোতে এই নীতিবচনকে কোন প্রেক্ষাপটে বিচার করা হয়েছে, তা বুঝতে চেষ্টা করব।
বিক্রম-চরিতে বসুধৈব কুটুম্বকম
শতাব্দী পেরিয়ে হিন্দু মনোজগতে স্থান করে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিহাস-খ্যাত ধারাবতীর ভোজদেব পারমার রাজ-ঐতিহ্যের স্থান অতুলনীয়। অন্যান্য রাজারা যেখানে শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে, সেখানে এই রাজার রাজ-ঐতিহ্য এখনো বহমান বিভিন্ন ধারায় - নাগরিক প্রবাদে, গ্রামীণ লোকসংগীতে, চড়াদাগের জোকস, পাণ্ডিত্যপূর্ণ পুরাণকথায়, জনপ্রিয় লোককথা – এসবই অনুপ্রাণিত হয়েছে সিংহাসন-বত্তিসি ওরফে দ্বাত্রিংশ-পুত্তলিকা-সিংহাসনম ওরফে বিক্রম-চরিত।
মনে করা হয়, সাধারণাব্দীয় একাদশ শতকে ভোজরাজের সময়ে বা তার কিছু পরেই, বত্রিশটি গল্পকথার সংকলন লিখিত হয়েছিল এবং তারপরেই ১৩০৫ সালের মধ্যেই এই গল্পকাহিনী এতো জনপ্রিয় হয়েছিল যে, তা এমন কি বহু দূরের মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, সেখান থেকে তা পরে রাশিয়া ও জার্মানিতে পৌঁছেছিল। যার ফলে, এমনকি আজও ‘অর্জি বুজি’ (রাজা ভোজ থেকে) নামে এক নায়ককে মঙ্গোলিয়ার লোককথায় পাওয়া যায় এবং জার্মানিতে গ্রিমের গল্পকথায় অন্ততপক্ষে একটি গল্পের উৎস হচ্ছে এই বিক্রম-চরিত।
এই গল্পকথার কাঠামোটা এমনই যে, প্রত্যেক গল্পেই বত্রিশ-পুতুলের দ্বারা ধরে রাখা সিংহাসনে রাজা ভোজ আরোহণ করতে চেষ্টা করে। আর প্রত্যেকবারই একজন করে পুতুল রাজা ভোজকে মহান বিক্রমাদিত্যের একটা করে গল্প বলে এবং রাজা ভোজের কাছে জিজ্ঞাসা করে, তিনি এমন মহান কিনা। প্রত্যেকটা গল্প শুনেই রাজা ভোজ নিঃশব্দে বিনয় সহকারে সিংহাসন আরোহণ করা থেকে বিরত থাকেন এবং শেষে ‘ঈশ্বরের আদেশে’ তিনি রাজ-সিংহাসনের জন্য উপযুক্ত ঘোষিত হন, যা লেখকের এক প্রতীক-উপায়, যার মাধ্যমে রাজা ভোজকে মহান বিক্রমাদিত্যের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এই জনপ্রিয় গল্পকথার সংকলনেই পরে আমরা সেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটিকে পাই, যা ইতিবাচক রূপেই দেখানো হয়েছে। বিক্রম-চরিতের ছয়টা প্রধান সংকলন পাওয়া গেছে: দক্ষিণ ভারতীয় সংকলন, যার পান্ডুলিপি অন্ধ্রে পাওয়া গেছে; অনুষ্টুপ ছন্দে লিখিত একটি সংকলন; একটি সংক্ষিপ্ত গদ্য সংকলন; প্রধানত মধ্য ও পশ্চিম ভারত থেকে দেবনাগরী লিপিতে দুটি জৈন সংকলন গ্রন্থ; এবং শেষে ভারুচির সংকলন গ্রন্থ। এছাড়াও আরেকটি জনপ্রিয় গল্পকথার সংকলন পাওয়া যায়, যেখানে বিক্রম-চরিত পাওয়া যায়, যা বেতাল পঞ্চবিংশতি বা বেতাল-পচিশি: পঁচিশটি বেতাল গল্পকথার সমাহার নামে পরিচিত, যেগুলির উৎস বত্রিশ সিংহাসনের গল্প।
ওপরের ছয়টি সংগ্রহগ্রন্থের মধ্যে তিনটি আলাদা আলাদা গ্রন্থে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি পাওয়া গেছে।
দক্ষিণ ভারতীয় সংগ্রহগ্রন্থের তেলেগু পাণ্ডুলিপিতে এই শ্লোকটি একটি গল্পের প্রথমেই পাওয়া গেছে, যেখানে সুপ্রভা নামের তৃতীয় পুতুলটি সর্বস্ব-দক্ষিণা-যজ্ঞ-বর্ণানাম গল্পে শ্লোকটি রাজা ভোজকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল। এখানে, জনপ্রিয় আঙ্গিকের পরিবর্তে এই শ্লোকটি ভিন্নভাবে উল্লেখিত হয়েছে:
“অয়ম্ নিজ পরবেতি বিকল্প ভ্রান্ত-চেতসাম পুনস্তুদার চিন্তানাম বসুধৈব কুটুম্বকম” (বি.চ., অন্ধ্র, ৩.১)
এই গল্পের বিষয়ই হলো, বিক্রমাদিত্যের বৈরাগ্যের বিজয় বার্তা। একবার রাজা উজ্জয়িনীতে এক রাজসূয় যজ্ঞ করবেন বলে মনস্থির করে সমুদ্র-দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এক ব্রাহ্মণকে দূত হিসেবে দক্ষিণে পাঠালেন। যদিও সমুদ্র-দেবতা আসলেন না, তবে তিনি ব্রাহ্মণের মাধ্যমে রাজা বিক্রমাদিত্যকে চারটি বিরল রত্ন উপহার হিসেবে পাঠালেন, প্রত্যেক রত্নেরই আলাদা ধরনের জাদু ক্ষমতা ছিল। কিন্তু, উজ্জয়িনীতে সেই দূত ফিরে আসার আগেই রাজার যজ্ঞ শেষ হয়ে গেল এবং রাজা সবাইকে সব উপহার বিতরণ করে দিয়েছিলেন। ফলে, তার কাছে আর কিছুই না থাকার জন্য, রাজা সেই ব্রাহ্মণ-দূতকে বললেন, সেই চার রত্নের মধ্যে নিজের পছন্দ অনুযায়ী যে কোনো একটি রত্ন উপহার হিসেবে বেছে নিতে। ঠিক এই সময় কোন রত্ন বেছে নেবেন, তা নিয়ে সেই ব্রাহ্মণ, তার পত্নী, পুত্র ও পুত্রবধূর মধ্যে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক শুরু হলো। শেষে, তারা যখন কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না, তখন রাজা বিক্রমাদিত্য নিজের কাছে ধন-সম্পদ না থাকলেও চারটি রত্নই সেই ব্রাহ্মণকে দিয়েদিলেন।
জৈন গ্রন্থে এই বসুধৈব শ্লোকটিকে বলতে দেখা যাচ্ছে চিত্তাকর্ষক পরোপকার্য-স্বদেহহুতি-দান আখ্যানে, যেখানে সুপ্রভা হচ্ছে সতেরোতম পুতুল। এই গল্পটি বিক্রমাদিত্যের মহানুভবতা ও তার দানশীলতাকে তুলে ধরেছে। এই গল্পে দেখা যায়, বিক্রমাদিত্যের মহানুভবতার প্রশংসা শুনে এক অখ্যাত রাজ্যের রাজা খোঁজ নিচ্ছেন, বিক্রমাদিত্যকে কেন মহান বলা হচ্ছে। তিনি জানতে পারলেন, বিক্রমাদিত্যের অপর দানশীলতার জন্যই তাকে মহান বলা হচ্ছে। তখন ঈর্ষাকাতর হয়ে সেই অখ্যাত রাজা স্থির করলেন, তিনিও প্রচুর ধন-সম্পদ দান করবেন। কিন্তু, পর্যাপ্ত ধন-সম্পদ না থাকার জন্য তিনি তন্ত্র-প্রয়োগের মাধ্যমে ধন-সম্পদ সৃষ্টি করার কথা বিবেচনা করলেন। তিনি চৌষট্টিজন তন্ত্র-যোগিনীকে নিয়োগ করলেন এক বিশেষ তন্ত্র-যজ্ঞ করে প্রত্যেকবার যাতে পরিমাণ মতো সোনা-দানা পাওয়া যায়। অবশ্য, এই যজ্ঞে প্রত্যেকবারই রাজাকে নিজের দেহকে আহুতি দিতে হতো, যা যোগিনীরা যজ্ঞ শেষে নতুন দেহ হিসাবে ফিরিয়ে দিত। এই যন্ত্রণাদায়ক যজ্ঞ কয়েকবার করার পর এই খবর বিক্রমাদিত্যের কানে গিয়ে পৌঁছাল। সেই জন্য, একদিন এই যজ্ঞ চলাকালীন বিক্রমাদিত্য স্বয়ং উপস্থিত হয়ে আহুতি দেওয়ার সময়ে নিজেকে যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিলেন। এতে যোগিনীরা অত্যন্ত প্রীত হল, এবং বিক্রমাদিত্যকে পুনর্জীবিত করে তাকে এক বিশেষ ক্ষমতা বর দান করল। এই গল্পের ক্লাইম্যাক্স হলো, বিক্রমাদিত্য যোগিনীদের কাছে প্রার্থনা করলেন, যাতে সেই ঈর্ষান্বিত রাজাকে এই যন্ত্রণাদায়ক যজ্ঞাহুতির মাধ্যমে ধন-সম্পদ না পেতে হয়।
অন্য আরেকটি জৈন গ্রন্থে এবং ১৪৩৭ সাধারণাব্দে পন্ডিত শুভশীল গণীর লেখাতে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে আরেকটি গল্পে আবার পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বিক্রমাদিত্যের ন্যায়পরায়ণতাকে দেখানো হচ্ছে।
অন্যান্য সংকলনগ্রন্থে এই শ্লোকটিকে পাওয়াই যাচ্ছে না। কাকতালীয়ভাবে, রাজা ভোজদেবও কৌটিল্যকে উল্লেখ করে একটি সুভাষিতগ্রন্থ লেখেন (বা, লেখার ব্যবস্থা করেন), যার নাম চাণক্য-রাজনীতি-শাস্ত্র এবং এই শ্লোককে সেখানে আর পাওয়া যাচ্ছে না।
এইভাবে বিক্রম-চরিতে আমরা বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে পাই রাজা বিক্রমাদিত্যের মহানুভবতা ও ন্যায়পরায়ণতার নিদর্শন হিসাবে। কিন্তু, তা কোনোভাবেই আজকের সর্বজনীন ভাতৃত্ববোধক নীতি-আদর্শের ভুল ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।
ধ্রুপদী সাহিত্যে বসুধৈব কুটুম্বকম
এখন বিক্রম-চরিতের বিভিন্ন সংকলনগ্রন্থের লেখক যদি নায়ক হিসেবে বিক্রমাদিত্যের মহানুভবতা দেখানোর জন্য বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে উল্লেখ করে থাকেন, তবে তা নিশ্চয়ই মহত্ত্বের নিদর্শন হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, এই শ্লোকটি উদাহরণ হিসেবেই বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন হল, তার উৎসগুলি কি?
আমাদের বুঝতে হবে, এইসব সংকলনগ্রন্থের রচনাকালে সংস্কৃত সাহিত্যে কাব্যতত্ত্ব ইতিমধ্যেই একটা শাস্ত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এই সময়কালে শুধুমাত্র সংস্কৃত সাহিত্যিকরা নয়, সমাজের উচ্চবর্গের মধ্যেও - ভাবাবেগের চরিত্রায়ণে, প্রকাশভঙ্গিতে, বিশেষ উদ্দেশ্যে সঠিক ছন্দোবদ্ধতায়, ব্যাকরণের সীমার মধ্যেই কাব্য-স্বাধীনতা, নতুন শব্দভান্ডারের প্রয়োগ পদ্ধতি - এসবই চর্চিত হচ্ছে। কাব্যতত্ত্বের বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রধান ধারা, যেমন, বৈদর্ভ, কাশ্মীরি, গৌড়ীয় ধারা ইত্যাদি গড়ে উঠেছে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, এই সময়ে কোন সাধারণ টেক্সট থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুভাষিতগুলির বিশ্বকোষের মতো সংকলনগুলি এবং সাধারণ্যে প্রচলিত বিভিন্ন প্রবাদ, নীতিমালাগুলি ব্যবহৃত হতে শুরু হয়ে গিয়েছে। এই সংকলনগুলি, যেগুলি কোষ বা সমগ্র নামে পরিচিতি লাভ করেছে, সেগুলিকে নাট্যবিদরা, গদ্য-লেখকরা যেমন, বিক্রম-চরিতের লেখকরা স্থান-কাল-পাত্র-ভেদে ব্যবহার করা শুরু করেছেন।
বল্লবদেবের সুভাষিতাবলী এমনই এক সংগ্রহসমগ্র, যেখানে বিভিন্ন কবি-লেখকদের কয়েক হাজার কাব্য-লিখন বিষয়ভিত্তিক ভাবে সংগৃহীত হয়েছে। এই সুভাষিতাবলীতে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে ঔদার্যের এক মহান নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যা নীচে দেওয়া হল:
“অয়ম্ বন্ধুঃ পরোবেতি গণনা লঘুচেতসাম পুংসামুদার চিত্তনাম বসুধৈব কুটুম্বকম” (উদারাঃ, ৪৯৮)
বল্লবদেব এই শ্লোকটিকে ঔদার্য্য-প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রেখেছেন (হাস্যকর ভাবে কৃপণদের পরে)। বল্লবদেব আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন যে, এই শ্লোকের রচনাকার হলেন কাশ্মীরের অষ্টম শতকের কবি উদভাত ভট্ট, যিনি কাশ্মীরি কাব্যতত্ত্বের ধারায় দিকনির্দেশকারী ছিলেন; যে ধারা শুরু হয়েছিল ভামহের হাতে এবং পরিণতি লাভ করেছিল মাম্মতার হাতে।
এখন আমাদের দেখা দরকার, কোথায় ও কোন প্রেক্ষিতে উদভাত এই শ্লোকের ব্যবহার করেছেন। উদভাত ভট্টের প্রধান তিনটি রচনায় ও তার অন্যান্য রচনাতেও এই শ্লোককে পাওয়া যাচ্ছে না। তার সমসাময়িকদের লেখা থেকে জানতে পারি যে, উদভাত ভামহের ওপর ভামহ-বিবরণ রচনা করেন। এছাড়াও লেখেন কুমারসম্ভব কাব্য ও কাব্যলংকার-সার-সংগ্রহ, যা কাব্যতত্ত্বের উপর এক উল্লেখযোগ্য রচনা। এগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি হারিয়ে গেছে - প্রথমটি মনে হয় মাম্মতার দিকনির্দেশক রচনার পরে আর ব্যবহৃত হয়নি, এবং কুমারসম্ভব সম্ভবত একই নামের সংস্কৃত সাহিত্যের সম্রাট কালিদাসের কুমারসম্ভবের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে গেছে। অবশ্য, উদভাত ভট্টের কাব্যলংকার-সার-সংগ্রহ এখনো পাওয়া যাচ্ছে ও আরো কিছু রচনা, যার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে অন্যান্য লেখকদের লেখায়, যেমন, মহাপন্ডিত অভিনবগুপ্তের শিক্ষক ইন্দুরাজার লেখা লঘুবৃত্তিতে বা বল্লবদেবের সুভাষিতবলীতে, যেখানে উদভাতের তিনটি কবিতা স্থান পেয়েছে, যেখান থেকেই আমরা তার নাম পাই।
কাজেই, এটা খুবই সম্ভব যে, উদভাত কিছু রচনায় বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি ব্যবহার করেছিলেন, যা পরে লুপ্ত হয়ে গেছে। তবে, শ্লোকের ব্যবহারের প্রেক্ষিতটা আমরা জানতে পারছি না। তবে তিনি অবশ্যই এই শ্লোকের প্রকৃত রচনাকার নন। কারণ, তার হাজার বছর আগেই বিষ্ণুশর্মা পঞ্চতন্ত্রে তা লিখেছেন।
কাব্যতত্ত্ব, বিক্রমাদিত্য ও রাজা ভোজের সঙ্গেই অন্য আরেকটি নাম আমাদের সামনে চলে আসে। তিনি বিক্রমাদিত্যের ভবঘুরে অগ্রজ ভাই ভর্তহরি। ভর্তহরির তিনটি বিখ্যাত গ্রন্থ, প্রতিটিই একশত শ্লোকের - নীতিশতকম্, বৈরাগ্যশতকম্ এবং শৃঙ্গারশতকম্। যদিও এই শতক-গ্রন্থগুলোতে ঐ বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের উল্লেখ পাই না। তবে মার্কসিস্ট ঐতিহাসিক ডি. ডি. কোশাম্বি সম্পাদিত একটি গ্রন্থেই শুধু ঐ শ্লোকের উল্লেখ পাই। [ভর্তহরি-বিরচিত শতকত্রয়াদি সুভাষিত-সমগ্র, ডি. ডি. কোশাম্বি (১৯৪৮)]। অবশ্য ভর্তহরির শতকত্রয়ের বিভিন্ন সংকলনগ্রন্থের মধ্যে ঐ শ্লোকের অনুপস্থিতি দেখে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, কোশাম্বির সম্পাদিত গ্রন্থের উৎস শুধুমাত্র একটিই মাত্র উৎস যার থেকে এই উল্লেখ তিনি করেছেন। তাছাড়া, এই শ্লোকটি যেহেতু পূর্বেকার গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত হয়েছে, তাই ভর্তহরি এই শ্লোকের প্রকৃত রচনাকার নন।
উপনিষদে বসুধৈব কুটুম্বকম
এতোক্ষণ আমরা পর্যালোচনা করেছি হিতোপদেশ, পঞ্চতন্ত্র, কৌটিল্য ও ভর্তহরির নীতিবচনের সংকলনগ্রন্থসমূহ, বিক্রম-চরিতের অন্ধ্র ও জৈন সংকলনগুলি, বল্লবদেবের এনসাইক্লোপেডিক সংকলনগ্রন্থ এবং তার মাধ্যমে প্রাপ্ত রচনা। এগুলির মধ্যে একটাতেও কোনো একজন লেখকও বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের প্রকৃত রচনাকার হিসেবে দাবী করেননি। প্রত্যেকটি উদাহরণ ক্ষেত্রেই, ‘এ রকম বলা হয়’ - এভাবেই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি ব্যবহৃত হয়েছে।
কিম্তু, এক ও একমাত্র ব্যতিক্রমী হিসাবে স্বাভাবিক, অন্তর্নিহিত ও মূলভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য হিসেবে এই শ্লোকটিকে দেখা গেছে যে মূললেখাতে, তার কথাই এবার শেষে আমরা পর্যালোচনা করব।
ব্রহ্মসূত্রের বিখ্যাত ভাষ্য শ্রীভাষ্যমের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সপ্তম অধিকরণে ভাষ্যকার আচার্য্য রামানুজ শৈব-মাতাদের কাপালা, কালামুখ ও পাশুপত দার্শনিক ধারার সমালোচনা করেছেন তার ভাষ্যের ছত্রিশতম সূত্রে। যেখানে তিনি তার যুক্তির স্বপক্ষে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত উপনিষদ – মহোপনিষদের (একো হা বৈ নারায়ণা অসিন্নব্রহ্ম নেশনাহ … সা একাকী ন রমতে” ম.উ. ১.১) প্রথম শ্লোক উল্লেখ করেছেন। এখন, যদিও এই উপনিষদ খুব বেশি প্রচলিত নয়, তথাপি এর প্রামাণিকতা ও গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কারণ, আমরা দেখেছি, অনেক প্রাচীন বেদান্ত-বিশারদ এই মহোপনিষদের কথা উল্লেখ করেছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পুরুষ-নির্ণয়ে যমুনাচার্য, তত্ত্ব-নির্ণয়ে নারায়ণাচার্য এবং ভগবদগীতার ভাষ্যে যাদবপ্রকাশ।
বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকেরই একটি পরিবর্তিত রূপ পাই মহোপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের বাহাত্তরতম শ্লোকে। এখানে, ‘অয়ম্ নিজঃ পরোবেতি’র পরিবর্তে শ্লোকে পাই ‘অয়ম্ বন্ধুরায়ম নেতি’ (ইনি একজন বন্ধু, অন্যজন বন্ধু নন), অনুষ্টুপের বাকি অংশ একই আছে।
এখানে মহোপনিষদে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের সামগ্রিক অর্থ-ব্যঞ্জনা তথা প্রেক্ষিত বুঝতে ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৭০ - ৭৩ থেকে শ্লোকগুলি উল্লেখিত হলো:
উদারঃ পেশলাচারঃ সর্বাচারানুবৃত্তিমান
অন্তঃ সঙ্গ-পরিত্যাগী বহিঃ সংভারবনিব।।
অন্তবৈরাগ্যমাদায় বহিরাশোন্মুখোহিতঃ
অয়ং বন্ধুরয়ং নেতি গণনা লঘুচেতসাং
উদারচরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম
ভাবাভাব বিনির্মুক্তং জরামরণবর্জিতং
প্রশান্ত কলনারভ্যং নীরাগং পদমাশ্রয়
এষা ব্রাহ্মীস্থিতিঃ সচ্ছা নিষ্কামা বিগতাময়া
আদায় বিহরন্নেবং সংকটেষু ন মুহ্যতি।। (মহোপনিষদ ৬.৭০-৭৩)
ওপরের শ্লোকগুলি আধ্যাত্মিক জগতে ব্রাহ্মীস্থিতি-প্রাপ্ত মহান ব্যক্তিদের লক্ষণাদি ও আচরণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
“(ব্রাহ্মীস্থিতি-প্রাপ্ত ব্যক্তি সর্বদাই উদার, ব্যবহারে পরিশীলিত, সামাজিক আদর্শযুক্ত এবং সমস্ত রকমের আসক্তিমুক্ত। ব্যবহারিক দিক থেকে অন্যান্যদের মতোই জাগতিক সাংসারিক কর্তব্যকর্ম করলেও, তারা মনের দিক থেকে আসক্তিহীন। ক্ষুদ্রমনা সাংসারিক লোকেরা যদিও ‘এ আমার আপন, ও আমার আপন নয়’ বলে, কিম্তু ব্রাহ্মীস্থিতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা উদার মনের হন এবং সারা পৃথিবীর সবাইকে আত্মীয় ভাবেন। তারা জাগতিক দুঃখ-কষ্ট, জরা-ব্যাধি-মৃত্যু থেকে মুক্তি পান। কোনো ধরনের আসক্তির বশীভূত তারা হন না। এই ভাবে যারা ব্রাহ্মীস্থিতি পান, তারা সর্বশুদ্ধ, তারা সমস্ত ধরনের আকাঙ্ক্ষা ও দুঃখ ভোগের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এই শুদ্ধগুণের অধিকারী হয়ে আসক্তিহীন, ক্লেশমুক্ত হয়ে তারা জগতের সর্বত্র বিচরণ করেন।"
কাজেই শ্লোকগুলি মহোপনিষদে কোন পরামর্শ, সুপারিশ বা আদর্শ বা সমাজের লক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি; ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতার বাইরে এই শ্লোকের কোন ব্যবহারযোগ্যতা নেই। বরঞ্চ, ব্রহ্মবেত্তাদের চরম প্রাপ্তির নিদর্শন হিসেবেই এইসব শ্লোকের উল্লেখ করা হয়েছে।
উপসংহার
আমরা এতোক্ষন সংস্কৃত সাহিত্যের বনরাজির মধ্যে দিয়ে যেন এক অভিযান করলাম, যাতে করে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটির উৎস কি, তার নিহিতার্থ কি, কোন প্রেক্ষাপটে প্রাচীন আচার্যরা এই শ্লোক উল্লেখ করেছেন, এবং আদৌ তারা এই শ্লোককে নিঃশর্ত সর্বজনীন ভাতৃত্ববোধক আদর্শ বা রাষ্ট্রনীতি হিসেবে ব্যবহার করতে বলেছেন কি না - এসবের উত্তর খুঁজলাম। এছাড়াও, হিন্দু-ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালে এই শ্লোকের উৎস ও তার প্রসার আমরা পর্যালোচনা করলাম।
১. মহোপনিষদ (৬.৭২) এই শ্লোককে ব্যবহার করেছে এক ব্যক্তি-মানুষের আধ্যাত্মিক জগতে চরম শিখরে ব্রাহ্মীস্থিতির লক্ষণ হিসাবে। আমরা আগেই যেমন দেখেছি, মহোপনিষদই একমাত্র টেক্সট যেখানে বসুধৈব কুটুম্বকম সেই মূল টেক্সটের মূলভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া, অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই এই শ্লোককে মূলভাবের বাইরের অংশ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে। সেইজন্য, আমরা খুব যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, এই মহোপনিষদই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের প্রকৃত উৎস।
প্রকৃতপক্ষে, প্রকৃতিগতভাবেই উপনিষদকগণ তাদের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তাই ব্যক্ত করেছেন, যদি না তারা বেদসমূহ বা অন্যান্য উপনিষদ থেকে কোন থিম/ভাবনা বা উক্তি করে থাকেন। কিম্তু কখনোই বেদ-উপনিষদের বাইরের অন্য কোন উৎস তারা ব্যবহার করেন নি। যদিও উল্টো ঘটনা ঘটেছে - উপনিষদের বিভিন্ন উক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া, কোনো একটি উপনিষদ কোন জনপ্রিয় শ্লোককে তার অন্তর্নিহিত মূলভাবের অঙ্গীভূত করেছে - তা অকল্পনীয়।
প্রকৃতপক্ষে, এই মহোপনিষদ, যেখানে এই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি ও অন্যান্য প্রাচীন টেক্সটের উক্তি আছে, যা পঞ্চতন্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে, তা এই উপনিষদের এই অংশের প্রাচীনতাই প্রমাণ করে।
তাছাড়া, অনেক বৈদান্তিক ভাষ্যকারও, বিশেষ করে বৈষ্ণব-ভাষ্যকারদের তাদের ভাষ্যে এই শ্লোকের ব্যবহার জনপ্রিয়তাকেই বোঝায়: যেমন, রামানুচার্যের (~ ১০৮০ সাধারণাব্দ) শ্রীভাষ্যমে (২.৭.৩৬), যমুনাচার্যের পুরুষ-নির্ণয়ে, নারায়ণাচার্যের তত্ত্ব-নির্ণয়ে, যাদবপ্রকাশের ভগবদগীতার ভাষ্যে, এবং শংকরানন্দের (~ ১৩০০ সাধারণাব্দ) মহোপনিষদের উপর এক সম্পূর্ণ ভাষ্যে।
মানসতরঙ্গিণীর আচার্য্য মত প্রকাশ করেছেন, মহোপনিষদের কিছু অংশ সম্ভবত মহাভারতের পূর্বের, যা শান্তিপর্বের নারায়নীয় উপপর্বে মহোপনিষদের নাম একবার নয়, দু’বার উল্লেখের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে:
মহোপনিষদং মন্ত্রম অধীয়ানান স্বরান্বিতম পঞ্চোপনিষদের মন্ত্রের মনসা ধ্যায়তঃ শুচি।।
এবং
ইদং মহোপনিষদং চতুর্বেদ-সমন্বিতম সাংখ্যযোগকৃতং তেন পঞ্চরাত্রানুশব্দিতম।। (নারায়নীয়, শান্তিপর্ব, মহাভারত)
এটা সম্ভব যে, মন্ত্রমার্গ-পঞ্চরাত্রর পূর্বে বৈষ্ণবদের নিশ্চয়ই একটা মহোপনিষদ ছিল, যা একই নামে মূল টেক্সট হিসেবে আজও পাওয়া যাচ্ছে। যার থেকে বলা যায়, ঐ মহোপনিষদের মূলটেক্সটে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি ছিল। তার অর্থ হলো, এই ধরনের মূল মহোপনিষদ অবশ্যই ছিল এবং জনপ্রিয় হওয়ার পর তারা তা তাদের লেখায় উল্লেখ করেছিলেন।
২. পঞ্চতন্ত্রে (৫.৩.৩৭) আছে, লেখক ঘোষিত এক বোকা-বিদ্বান এই শ্লোকটি ঘোষণা করেছে, যে নিজের বোকামির জন্য নিহত হয়েছে, যা বাস্তব জ্ঞানের অভাব প্রমাণ করে। এই সাহিত্য কর্মটি নিশ্চিতভাবেই মৌর্য যুগের শেষের দিকে রচিত হয়েছিল। সেই সময় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, বৈদেশিক আক্রমণের সঙ্গে আস্তে আস্তে ছোট ছোট রাজ্যও গড়ে উঠছে। সামাজিক ক্ষেত্রে, জৈন, বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব ধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এইরকম সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ও শান্তিকামী ভাবধারার বিপরীতে বিষ্ণশর্মা নিশ্চয়ই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের অর্বাচীন ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন, যেখানে ঐ বাণীদাতা বোকা লোক নিজের মূর্খতার জন্য নিজেই নিহত হয়েছিল।
৩. হিতোপদেশ (১.৩.৭১) পঞ্চতন্ত্র থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল এবং দুটো ব্যাঙ্গার্থক গল্পে দেখিয়েছিল যেভাবে সাবভারসনিষ্টরা এর ব্যবহার করে ও সহজবিশ্বাসীরা তাদের খপ্পরে পড়ে। হিতোপদেশ প্রকৃত বীরনায়কদের প্রশংসাও করেছিল, যারা ঐ শ্লোকের দ্বারা প্রভাবিত হয় নি।
এই হিতোপদেশের রচনা কিছু পূর্বেই, লক্ষ করা যায়, পঞ্চতন্ত্রের দক্ষিণ-ভারতীয় সংস্করণ হিতোপদেশের ঐ রকম বার্তাই দিয়েছে। সেই ধরনের বার্তার ছবিই আমরা পাই মহাবলীপুরমের মন্দির গাত্রে খোদাই চিত্রে, যার চিত্র এই নিবন্ধের শেষে দেয়া হয়েছে।
৪. কৌটিল্যের সংগ্রহগুলিতেও, শুধুমাত্র দুটো ক্ষুদ্র সংগ্রহগ্রন্থ ছাড়া, এই শ্লোকের উল্লেখ নেই। এছাড়াও, কৌটিল্যিয় ভাবধারা বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের তথাকথিত ভাবধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
৫. অষ্টম শতকের উদভাত ভট্ট তার কাব্যকর্মে যদিও এই শ্লোকের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তার প্রেক্ষিতটা আমরা জানি না।
৬. সুভাষিতবলীতে (উদারা. ৪৯৮) এই শ্লোকটি মহানুভবতার নিদর্শন হিসেবে কাব্যের উৎকর্ষের জন্য সুভাষিত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এটাও বলা দরকার যে, সাধারণ জনসমাজ ততদিনে এই শ্লোকের প্রকৃত উৎস কি, তা ভুলে গেছে। যেমন দেখা যাচ্ছে, পল্লবদেব ভুলভাবে এই শ্লোকের রচনাকার হিসেবে অষ্টম শতকের কাশ্মীরি কবি উদভাত ভট্টের নাম করেছেন। তিনি, এমন কি জানতেন না যে, জনপ্রিয় পঞ্চতন্ত্রেই এই শ্লোকের উল্লেখ আছে।
৭. বিক্রম-চরিতের (অন্ধ্র ৩.১, জৈন ১৭.৩, শুভশীল ৬.২৭০) তিনটি সংস্করণেই এই শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে উদারতা ও ন্যায়ের প্রেক্ষিতে; কিন্তু, সর্বজনীন ভাতৃত্ববোধের আদর্শ হিসেবে নয়।
অতএব, আমরা নিশ্চিত ভাবেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, মহোপনিষদে এই শ্লোক যে প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়েছে এবং পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ ও বিক্রম-চরিতে যেভাবে এই শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে, তা উপেক্ষা করে আজকের রাজনীতিকরা ও নীতিনির্ধারকরা প্রাচীন উদারবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের তথাকথিত উত্তরসূরি হিসেবে যেভাবে এই শ্লোক ব্যবহার করেন, তাতে বলা যায় যে, বসুধৈব কুটুম্বকম এক ছলনার বেশি কিছু নয়। যখন প্রাচীন ভারতের স্বপ্নালু সর্বজনীন ভাতৃত্ববোধক আদর্শের হিন্দু-সংস্করণ হিসেবে আজকের পণ্ডিতরা উল্লেখ করেন, তাতে বলাই যায়, এই শ্লোক এক ছলনা মাত্র। এছাড়াও, ধর্মপ্রচারকদের কাছ থেকে আমরা যখন শুনি, জনগণের কাছে বসুধৈব কুটুম্বকমের নীতি-আদর্শকে অনুসরণ করার জন্য প্রচার করতে, তখন এটা অবশ্যই বলতে হবে, আধ্যাত্মিকতার প্রেক্ষিতেও এই বসুধৈব কুটুম্বকম এক ছলনা মাত্র!
(তৃতীয় ও শেষ পর্ব)
ড. সুজিৎ রায়
No comments:
Post a Comment