রবীন্দ্রনাথ ও চেতনা রহস্য







কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির 'রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি'র 'সাহিত্য পত্র ১৪৩২' পত্রিকায় প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ।

রবীন্দ্রনাথ ও চেতনা রহস্য 

“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে। আমি চোখ মেললুম আকাশে, জ্বলে উঠল আলো পুবে পশ্চিমে।…” (আমি, শ্যামলী কাব্যগ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

চেতনা বা চৈতন্য কি? চেতনার স্বরূপ কি? চেতনাকে কি সংজ্ঞায়িত করা যায়? চেতনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল? সমসাময়িক বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের থেকে চেতনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি কতোটা আলাদা ছিল? এই নিবন্ধে এইসব নিয়েই খুব সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। 

সহজ ভাষায়, চেতনা (Consciousness) হল একজন ব্যক্তির বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অস্তিত্ব (Existence) সম্পর্কে সচেতনতা (Awareness)। অতএব, নিশ্চিত ভাবেই দেহ বা শরীর চেতনা নয়; তবে শরীর/দেহ সম্বন্ধে সচেতনতা অবশ্যই চেতনার এক পরিচায়ক। অনেকেই অবশ্য চেতনাকে মনের সমার্থক, বা মনের একটি দিক রূপে বিবেচনা করেন। তবে এই ব্যাখ্যারও সীমাবদ্ধতা আছে।

আভিধানিক অর্থে, চেতনাকে “কিছু বোঝার এবং উপলব্ধি করার অবস্থা”, “একটি পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন এবং প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ার অবস্থা”, “একজন ব্যক্তির সচেতনতা বা কোনো কিছুর উপলব্ধি”, “নিজের এবং বিশ্বের সচেতনতার সত্য” ইত্যাদি বিভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই, এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, চেতনার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে, চেতনার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অবশ্যই আছে উপলব্ধি, চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি থাকা।

চেতনার স্বরূপ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্ফুট হয়েছে তার অন্যতম কবিতা ‘শ্যামলী’ কাব্যগ্রন্থের ‘আমি’ কবিতায়। যখন তিনি বলেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ…’, তখনই ‘ব্যক্তি আমি’ যে চেতনার ভরকেন্দ্র তা প্রকাশিত হয়। ‘আমি’ই সুন্দরের পূজারী বলেই গোলাপ ‘সুন্দর’ হয়ে ওঠে; সব-ই ‘আমার’ অনুভূতি-উপলব্ধি-নির্ভর, ‘আমি-সাপেক্ষ’! অর্থাৎ, আমার চেতনা-সাপেক্ষ, আমার-ই দৃষ্টিভঙ্গি-সাপেক্ষ- ‘Perception is Reality’!

‘আমার’ কাছে এটাই ‘সত্য’! কিন্তু, ‘কে’ এই আমি? এখানেই কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি: এই ‘আমি’ হলেন “অসীম যিনি তিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা মানুষের সীমানায়, তাকেই বলে ‘আমি’।“ এই ‘আমি’ হলেন সেই ‘বৃহৎ আমি’- ‘বিশ্ব-আমি’! এখানেই অবধারিত এক প্রশ্ন উঠে আসে: ‘ব্যক্তি-আমি’র সঙ্গে সেই ‘বিশ্ব-আমি’র যোগসূত্র কি? ভারতীয় ধর্ম-দর্শনের অন্যতম ধারক-বাহক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তা হল: বিশ্বচেতনা। আর, এই বিশ্বচেতনা হল ‘মহাজাগতিক চেতনা’- মহাবিশ্বের জীবন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে সচেতনতা, যা ‘সরল চেতনা’- শরীরের সম্পর্কে সচেতনতা এবং ‘আত্ম চেতনা’- সচেতন হওয়ার সচেতনতার থেকে পৃথক।

চৈতন্য ও বিশ্বকে একীভূত করে দেখা এবং জগৎ ও মানুষ একে অপরের পরিপূরক- এই ছিল রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনচর্চা। বৈদিক গায়ত্রী মন্ত্র ‘ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ’ আত্মস্থ করে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ভূলোক, অন্তরীক্ষ ও তিনি ‘তার’ই সঙ্গে অখণ্ড-একাত্ম হয়ে আছেন। তাই, ‘বিশ্বদেবতা’ তার কাছে ‘জীবনদেবতা’ হয়ে ধরা দিয়েছেন। তার কাছে, ‘জীবনদেবতার সঙ্গে জীবনকে পৃথক করে দেখলেই দুঃখ, মিলিয়ে দেখলেই মুক্তি’। (মানবসত্য)

‘আত্মার দৃষ্টি’ রচনাতে কবি চেতনা ও আত্মাকে এক করে দেখেছেন। এই আত্মা/জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার পরম মিলনে বিশ্বজগৎ সম্মিলিত ও পরিপূর্ণ। আত্মাতেই তিনি পরমাত্মাকে দর্শন করেছেন, যা তার উপনিষদীয় উত্তরাধিকার ও উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিতেই তিনি ঈশ্বর ও প্রকৃতিকে একাত্ম করেছেন।

কবির কাছে, ‘কবিত্বহীন’ বিশ্বদেবতা বা বিধাতা যদি শুধুই “ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বের গণিততত্ত্ব নিয়ে” একা বসে থাকেন, তাহলে এই বিশ্বজগৎ হবে ভালোবাসাহীন, অসুন্দর। বিধাতার জগৎলীলা হবে অর্থহীন। মানুষ ছাড়া এই বিশ্বজগৎ হবে ‘ব্যক্তিত্ব’হীন, অ-চেতন। কারণ, মানুষই হল বিশ্বদেবতার চেতনার ধারক তথা বাহক। 

এখানেই অন্য বিশিষ্টজনেদের থেকে চেতনার স্বরূপ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির পার্থক্য বিশেষ অনুধাবন যোগ্য। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যতোগুলি কথোপকথন লিপিবদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হল রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইনের কথোপকথন। একজন হলেন বিশ্বকবি, অন্যজন বিশ্ববিজ্ঞানী। এই কথোপকথনের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল সত্য, সুন্দর, চেতনা ও মহাজাগতিক সত্তার স্বরূপ। এছাড়াও ভারতীয় সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ইউরোপীয় সঙ্গীতের পার্থক্য নিয়েও আলোচনা হয়েছিল।

আইনস্টাইনের কাছে, মহাবিশ্বের প্রকৃতির স্বরূপ দুই ধরনের: বিশ্বসত্তার বাস্তবতা মানুষ-নির্ভর এবং মানুষ-নিরপেক্ষ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে, বিশ্বসত্তা মানুষ-নির্ভর, জগৎ হচ্ছে মানবিক জগৎ। তাই আমাদের কাছ থেকে জগৎকে সরিয়ে রাখলে জগতের অস্তিত্ব থাকে না। এই জগৎ একটা আপেক্ষিক জগৎ এবং এর বাস্তবতা আমাদের চেতনা-নির্ভর। 

সৌন্দর্যবোধ যে মানুষ-সাপেক্ষ, রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যে আইনস্টাইন একমত হয়েছিলেন। কিন্তু, সত্য সম্বন্ধে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। পিথাগোরাসের উপপাদ্যে বিশ্বাসী আইনস্টাইনের মতে, সত্য মানবসত্তার নির্ভরতামুক্ত, যা নৈর্ব্যক্তিক ও স্থান-কাল-পাত্র-নিরপেক্ষ অর্থাৎ মানুষ/দ্রষ্টার উপর নির্ভরশীল নয়। সত্য সবসময়ই সত্য, মানুষ তা উপলব্ধি করুক বা না করুক। মন-নিরপেক্ষ সত্যের এই দার্শনিক অবস্থানই বাস্তববাদ বা রিয়েলিজম (Realism)।

তবে, রবীন্দ্রনাথের কাছে, সত্য মানবসত্তা-সাপেক্ষ, যা বিশ্বসত্তার মধ্যে সম্পৃক্ত। ‘মনের বাইরে’ কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে না- এটাই ‘অ্যান্টি-রিয়েলিজম।  বৈজ্ঞানিক সত্য বা যুক্তিসঙ্গত সত্য- উভয়ই মানুষের চিন্তা-উপলব্ধি-নির্ভর এবং এই সত্য মানুষের কাছে প্রতিভাত জগতের সত্য, যাকে ‘মায়া’ বা বিভ্রম বলা যেতে পারে। 

এখানেই আইনস্টাইনের কাছে মূল সমস্যা, সত্য মানুষের চেতনা-নির্ভর কি না! কারণ, যখন বাড়িতে কেউ নেই তখনও টেবিলটা যেখানে ছিল সেখানেই থাকে। রবীন্দ্রনাথের কাছে, সেটি ব্যক্তিমনের বাইরে থাকলেও সর্বজনীন মনের (Universal mind) বাইরে থাকে না। তাই, সত্য ব্যক্তিসত্তা-সাপেক্ষ, ব্যক্তিচৈতন্য-সাপেক্ষ, যা সর্বজনীন চৈতন্যের (Universal consciousness) অংশ। 

আর, রবীন্দ্রনাথের কাছে, এই বিশ্বজগৎ অবশ্যই উদ্দেশ্যমুখী এবং ব্যক্তিমানুষ তার অংশ। সেই বিশ্বজগৎ ব্যক্তি-আমির ভিতর দিয়ে সত্য হয়ে ওঠে, মূর্ত হয়ে ওঠে। মানুষের ব্যক্তি-চৈতন্য এইভাবেই বিশ্ব-চৈতন্যের অংশ হয়ে ‘আনন্দময়’ হয়, মানুষ ‘সুন্দর’ হয়ে ওঠে।

“তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর, তুমি তাই এসেছ নীচে। আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে”।

ড. সুজিৎ রায় 

No comments:

Post a Comment

রবীন্দ্রনাথ ও চেতনা রহস্য

কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির 'রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি'র 'সাহিত্য পত্র ১৪৩২' পত্রিকায় প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথ ও চ...