ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও ভারতীয় নাগরিকত্ব: এক নতুন নির্মাণ

ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও ভারতীয় নাগরিকত্ব: এক নতুন নির্মাণ - আমার এই নিবন্ধটি 'বঙ্গদেশ' নেট-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।
https://www.bangodesh.com/2020/01/person-state-citizenship/

‘ইতিহাস ভুল করে না, ভুলেও যায় না’

ব্যক্তির পরিচিতি বা পরিচয়-সত্তা যেমন এক মানসিক অবস্থা, তেমনি তা সমাজ তথা রাষ্ট্রিক প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত, এথনিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মবিশ্বাসগত, অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিক অবস্থাগত বিভিন্ন দিকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই পরিচয়-সত্তার নির্মাণ ব্যক্তির ‘সেলফ’ বা ‘আত্মগত-সত্তা’ থেকেই শুরু হয়, যা বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে আদান-প্রদানের সম্পর্কে সম্পর্কিত থাকে। এইভাবে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিগত সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে এক ‘পরিচয়-সত্তা’ গড়ে ওঠে, যার প্রধান তিনটি দিক: ব্যক্তিগত, সামাজিক ও উদ্দেশ্যমূলক।

একজন ব্যক্তি বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে তার পরিবারের মধ্য দিয়েই সম্পর্কিত হয়। পরিবার, যা প্রতিটি সমাজের প্রাথমিক একক তথা মূলভিত্তি, সেই পরিবারের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের শুরু করে। আবার সেই বৃহত্তর সমাজ ঐতিহাসিক বিবর্তন তথা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এই আধুনিক রাষ্ট্রকে এখন আমরা নেশন স্টেট বা জাতি রাষ্ট্র বলি। একটি রাষ্ট্রের প্রাথমিক চারটি প্রধান উপাদান থাকে: ভূমি, জনগণ, সরকার এবং সার্বভৌমত্ব। তাই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র একটি ত্রিভুজাকার সম্পর্কে মধ্যেই সম্পর্কিত থাকে। নেশন শব্দটির বাংলা বা সংস্কৃত ভাষায় প্রতিশব্দ নেই। সেই জন্য নেশন স্টেট বলতে শুধু একটা রাষ্ট্র বোঝায় না, সেই রাষ্ট্রের সঙ্গে তার নাগরিকদের মানসিক সম্পর্কের আবেগময় অবস্থাকেও বোঝায়।

এখন প্রশ্ন হলো, একজন ব্যক্তি তার রাষ্ট্রকে কিভাবে দেখেন? ঠিক এইখানেই নাগরিকত্বের প্রাসঙ্গিকতা। একজন নাগরিক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রের বিশেষ অধিকারযুক্ত আইনি অধিবাসী। আজকের পৃথিবী বিভিন্ন জাতি রাষ্ট্রের সমবায়। প্রত্যেক ব্যক্তি কোনো না কোনো জাতি রাষ্ট্রের সদস্য বা নাগরিক। এইখানেই ‘রাষ্টহীন’ নাগরিকের কথা আসে। অনুপ্রবেশকারী ও শরণার্থী/উদ্বাস্তু - এই দুই ধরনের রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিবর্গের কথা আসে, যার প্রেক্ষিত একদিকে মানবিক আরেক দিকে আইনি অবস্থা, এবং এই দুই ধরনের অভিবাসীদের ক্ষেত্রে দুটো ফ্যাক্টর কাজ করে, একটি হলো সুবিধাগ্রহণের উদ্দেশ্য, আর অন্যটি প্রয়োজন-সাপেক্ষ, অস্তিত্ব রক্ষার সাপেক্ষ।

আজকের পৃথিবীতে কোন রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব সাধারণ ভাবে চার রকম পদ্ধতিতে অর্জন করা যায়: বংশগত ভাবে/ডিসেন্ট,  ভৌগলিক সীমায় জন্মসূত্রে, বিবাহ সূত্র বা নিবন্ধীকরণ এবং স্বাভাবিকীকরণ/ন্যাচারালাইজেশন। বিভিন্ন দেশ এক বা একাধিক পদ্ধতির মাধ্যমে নাগরিকত্ব ঠিক করে। যেমন কিছু আরব দেশে শুধুমাত্র মুসলিম ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। কাজেই নাগরিকত্ব একটি রাষ্ট্রের তথা জাতি রাষ্ট্রের একেবারে নিজস্বতা সাপেক্ষ। সাধারণ ভাবে দেখা যায়, উদার-ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সিভিক-প্রজাতান্ত্রিক – এই দু’ধরনের প্যারাডাইম একটি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নাগরিকত্ব ও ভারতীয় জাতি রাষ্ট্র

১৯৪৭ সালে ধর্মবিশ্বাসের নিরিখে দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই অখন্ড ভারতবর্ষ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই রাষ্ট্রে পরিণত হল: ভারত ও পাকিস্তান। পরে ভারতীয় সংবিধানের ৫-১১ ধারার ভিত্তিতেই ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ ভারতীয় সংসদ দ্বারা প্রণীত হলো, যা বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত হয়েছে এবং যার শেষ সংশোধিত রূপটি হলো নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন, ২০১৯। এখন প্রশ্ন হল, এই নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটি কি অসাংবিধানিক, অনৈতিক, নাকি ধর্মীয় বিশ্বাসের নিরিখে বৈষম্যমূলক? এর সঙ্গেই একজন অনাগরিক ব্যক্তির নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশী আইন, ১৯৪৬ ও পাসপোর্ট আইন, ১৯৬৭ ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।

যদিও ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন আছে, তবে ভারতে কোন ‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জি’ নেই। ভারতীয়দের বিভিন্ন ধরনের পরিচিতি বা পরিচয় পত্র আছে। যেমন, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্যান কার্ড ইত্যাদি। কিন্তু ভারতীয়দের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন ‘জাতীয় নাগরিক পরিচয় পত্র’ নেই। আধার কার্ড নাগরিক পরিচয় পত্র নয়, তা শুধুমাত্র বায়োমেট্রিক পরিচয় পত্র। আবার ভারতীয় নির্বাচন আয়োগ যে ভোটার লিস্ট তৈরি করে, তার সাপেক্ষে ভোটার কার্ড প্রদান করে। কিন্তু, প্রকৃত আইনি অর্থে ভোটার কার্ড কখনোই নাগরিক পরিচয় পত্র নয়। ঠিক এইখানে জাতি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতে তার নাগরিকদের বিভিন্ন পরিচয় পত্রের সাপেক্ষে একটা হ্বেতাভাষ বা ফ্যালাসি তৈরি হয়েছে। ফল স্বরূপ,  ভারতীয় নাগরিকত্ব ঘিরে অনিশ্চয়তা ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

এখানে প্রধান প্রশ্ন, তাহলে ভারতীয় জাতীয় পরিচিতি ও নাগরিকত্বের ভিত্তি কি? ভারতীয় জাতীয় নীতি অবিসংবাদিত ভাবে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ ও ‘আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত’ – এই দুই নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।  ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সীমার মধ্যে সকলের জন্য সমান ভাবে রক্ষাকবচ দেওয়া - ভারতীয় জাতি রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য এবং এই বিশিষ্টতা ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল সুরকে মৌলিক অধিকার ধারাসমূহের মাধ্যমে যথাযথ ভাবে রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন, এই সাম্যের অধিকার ধারাটি ভারতে নাগরিকদের ক্ষেত্রে সব সময় প্রযোজ্য হলেও, তার ব্যতিক্রম কি প্রয়োগ হয় নি? বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিভিন্নতা ও বৈষম্যমূলক সত্যকে স্বীকার করে সেই সমস্ত সম্প্রদায়কে ‘বিশেষ সুবিধা ও অধিকার’ দেওয়া হচ্ছে না কি? তখন সাম্যের অধিকারের মূল সুর কি যৌক্তিক থাকছে? যদি সেই যৌক্তিকতা থেকে থাকে, তবে তা নিশ্চয়ই নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কারণ, এই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কোনো ভারতীয় নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই আইন শুধুমাত্র সেই সমস্ত অনাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা অখন্ড ভারতবর্ষের সভ্যতার মূলের অনুসারী। সেই অর্থেই এই আইন একদিকে যেমন সেকুলার, অন্যদিকে তেমনি ভাবেই ধর্মীয় নিপীড়িত মানুষদের ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে আশ্রয় দিয়ে নাগরিকত্ব প্রদান করতে চেয়েছে এবং এটা ‘ইতিবাচক বৈষম্যমূলক’ নীতির একটি উদাহরণ।

সামনের পথ

ভারতীয় জাতি রাষ্ট্রের পরম্পরা বা লিগ্যাসি কি? এটা অনস্বীকার্য যে, ভারতবর্ষ  দ্বিখন্ডিত  হয়েছিল ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতেই এবং ভারত রাষ্ট্র সেই লিগ্যাসি এখনো বহন করে চলেছে। দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতেই হয় যে, ভারতবর্ষের খন্ডিত অংশগুলো, যা মুসলিম প্রধান, সেই রাষ্ট্রগুলো ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবেই গড়ে তুলেছে এবং সেই রাষ্ট্রধর্মের ভিত্তিই হলো বৈষম্যমূলক ইসলামিক ধর্মীয় বিশ্বাস।

যদি আমরা বিগত দুশো বছরের ইতিহাস দেখি, যেখানে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের জনগণ যে স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান দিয়েছিল, তাহলে আমরা কখনোই সেই সব মানুষদের উত্তরাধিকারীদের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখতে পারি না। ভারতবর্ষের ভাগ হওয়ার জন্য খন্ডিত ভারতবর্ষের যে অংশগুলো এখন ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে সেখানকার সংখ্যালঘু অধিবাসীদের ভারতবর্ষীয় সভ্যতার লিগ্যাসি ভারত অস্বীকার করতে পারে না। তারা যে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে অখন্ড ভারতবর্ষের উত্তরাধিকারী হিসেবে যে নতুন ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে, সেখানে তাদেরকে শরণার্থী/উদ্বাস্তু অবস্থা থেকে নাগরিকত্ব প্রদান আজকের ভারতের নৈতিক দায়িত্ব। এটা ঠিক ভারত ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৫১ এবং ১৯৬৭ প্রোটোকলে সাক্ষর করেনি। কিন্তু ভারত রাষ্ট্র এইসব হাজার হাজার বছরের ভারতবর্ষীয় সভ্যতার অংশভাগী ধর্মীয় অত্যাচারিত, নিপীড়িত উদ্বাস্তু/শরণার্থীদের মানবিক কারণেই নাগরিকত্ব দিতে দায়বদ্ধ। সেই প্রেক্ষাপটেই ভারত সরকার সেই সমস্ত অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদান করছে। এই নাগরিকত্ব কোনো ভাবেই  বর্তমান ভারতীয় নাগরিকদের কোন ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে না।

এখানেই মূল প্রশ্ন যে, বর্তমান সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯ কি অসাংবিধানিক বা এই আইন কি বৈষম্যমূলক যা অনাগরিকদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে ধর্মীয় বিশ্বাস কে একমাত্র বিচার্য বিষয় করেছে? এই আইন কি ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারাকে লঙ্ঘন করেছে? এসবের উত্তর আমাদের ভারতীয় সংবিধানেই আছে, যেখানে যে কোন আইন  সংবিধান সম্মত হয়েছে কিনা তার বিচার সংবিধান দিয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়কে এবং প্রতিটি মানুষ, জনগোষ্ঠীর এই ভারতে অধিকার আছে যে কোনো আইনের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধতা করার। কিন্তু সেই আইনকে বিরুদ্ধতা করার নামে হিংসার আশ্রয় কোন সংবিধানসম্মত অধিকার হতে পারে না, যাতে অন্য নাগরিক বা জাতীয় সম্পত্তির ধ্বংস বা ক্ষতি করা হয়। তবে এটাও ঠিক, উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘এথনিক’ সমস্যার সাপেক্ষে এই উদ্বাস্তু-শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া এবং তাদের ভারতের অন্যান্য রাজ্যে কিভাবে পুনর্বাসন শেয়ার করে নেওয়া যায় তা ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে খুবই জরুরী। কারণ, ভারতীয় নাগরিকত্ব একক; প্রতিটি নাগরিক ভারতীয় নাগরিক, কোন একটি রাজ্যের নাগরিক নয়। কাজেই রাষ্ট্রের সামগ্রিক দায়িত্ব সব রাজ্যেরই মিলিত যৌথ দায়িত্ব।

@ সুজিৎ রায়
10.02.2020

No comments:

Post a Comment