বসুধৈব কুটুম্বকম: হিতোপদেশ পর্ব

'বসুধৈব কুটুম্বকম: ছলনার আরেক নাম - হিতোপদেশ পর্ব'
ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি কি অর্থে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার উপর সর্বেশ কে তিওয়ান তিন পর্বের নিবন্ধ লিখেছেন। আমি মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছি। এখানে প্রথম পর্ব।
প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গদেশ (bangodesh.com) নেট-ম্যাগাজিনে।
নিচে নিবন্ধের লিংক দেওয়া হল।
https://www.bangodesh.com/2020/02/vasudhaiva-kutumbakam-1/

The Hoax Called Vasudhaiva Kutumbakam-1: Hitopadesha 

By Sarvesh K Tiwan

‘বসুধৈব কুটুম্বকম’: ছলনার আরেক নাম -১ : হিতোপদেশ
- সর্বেশ কে তিওয়ান

অনুবাদক: ড. সুজিৎ রায়

"অয়ং নিজঃ পরোবেতি গণনা লঘুচেতসাম। উদার চরিতানাম তু বসুধৈব কুটুম্বকম।।"

- "এটা আমার, ওটা অন্যের - এই ভাব শুধু এক ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী মানুষের। এক উদার চেতনা সম্পন্ন মানুষ এই পৃথিবীর সবাইকে একই পরিবারভুক্ত ভাবে।"

বর্তমানে সংস্কৃত শাস্ত্রের বিভিন্ন শ্লোকের ওপর যদি সমীক্ষা করা যায়, তবে দেখা যাবে উপরের শ্লোকটি সবথেকে বেশি উক্ত হয়েছে। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ আজকের হিন্দুদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় শ্লোকাংশ। অবশ্য এখন এই শ্লোকটি সেকুলারবাদীদের কাছে প্রায় ফেটিশের পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং শ্লোগানসর্বস্ব হয়ে উঠেছে। এই শ্লোকটি এখন আপাতদৃষ্টিতে তাদের কাছে বহুত্ববাদ বা মাল্টিকালচারালিজম এবং সর্বজনীনতাবাদ বা ইউনিভার্সালিজমের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারাকে ছোট, ক্ষুদ্র মানসিকতা হিসেবে প্রতিপন্ন করার অস্ত্র হয়ে উঠেছে। ফলে, যারা এমনিতে সংস্কৃত ভাষাকে হেয় গন্য করেন, তারা সুযোগ মত এই শ্লোকটি ব্যবহার করেন।
এখন কয়েকটি ক্ষেত্রে এই শ্লোকের ব্যবহার কি রকম হয়েছে, দেখা যাক:

১) ব্রাসেলসসে  ২০০৬ সালের ১১ নভেম্বর বেলজিয়াম সরকার দ্বারা প্রদত্ত পুরস্কার ‘গ্র্যান্ড অফিসার অফ দি অর্ডার অফ লিওপোল্ড’ গ্রহণ করার সময় শ্রীমতি সোনিয়া গান্ধী তার প্রদত্ত ‘কনস্ট্রাক্টিভ ন্যাশনালিজম এন্ড এফর্টস টু ফস্টার এ মাল্টিকালচারাল, টল্যারেন্ট সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া’ ভাষণপত্রে বললেন – "প্রায় ২০০০ বছর আগে ভারত ঘোষণা করেছিল, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ – ‘সারা পৃথিবী এক পরিবার’ "; এবং

২) নতুন দিল্লিতে ২০০৬ সালের ২৫ মার্চ ‘হার্ভার্ড আলুমনি অ্যাসোসিয়েশনে’ প্রদত্ত ভাষণে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং বলেছিলেন, "প্রাচীন ভারতে উদারবাদী ভাবধারা প্রতীয়মান হয়েছিল এই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ ধারণা দ্বারা, যা ‘সভ্যতার সংঘর্ষ তত্ত্ব’ (ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন)-এর বিপরীত” … আমি এই সংঘর্ষ তত্ত্বের বিরোধী। আমাদের সেই উদারবাদী ভাবধারাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।"

স্যামুয়েল হাটিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষ তত্ত্বের বিপরীতে যে বসুধৈব কুটুম্বকম তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে - উভয় তত্ত্বই গভীর ব্যঞ্জনাময়। সংস্কৃত শ্লোকটিকে তথাকথিত উদারবাদীরা ব্যবহার করছেন নেহরুবাদী উদার আন্তর্জাতিকতাবাদকে প্রাচীন ভারতের হিন্দু ভাবধারার অনুসারী হিসেবে, যাতে হিন্দু ঐতিহ্য দ্বারা তাদের ভাবাদর্শ বা আইডিওলজিকে  মান্যতা ও বৈধতা দেয়া যায় এবং প্রাচীন ভারতের উদার ভাবধারার প্রকৃত উত্তরাধিকার হিসেবে তাদের তথাকথিত উদার ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠা করা যায়।

যদি এই শ্লোকের জনপ্রিয়তাকে ভাষণের আলংকারিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো, তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। কিম্তু, উদ্দেশ্য যে আরো গভীর তার উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে ২০০৭ সালে ৫ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রদত্ত ভাষণে, যখন তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করলেন: “আমাদের বৈদেশিক নীতির ভিত্তি স্বরূপ হচ্ছে বসুধৈব কুটুম্বকম”।
সত্যিই স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি স্বরূপ হিসেবে এই শ্লোকটি বিবেচিত হয়ে আসছে। তাই ভারতের সংসদ ভবনের দেয়ালেও প্রতীক অর্থে এই শ্লোকটি গ্রথিত হয়েছে। 

এই ধারাবাহিক প্রদর্শনের ফলস্বরূপ, সাধারণ হিন্দুরাও এই লোকটিকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছেন। তারাও এই শ্লোকটিকে প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের গৃহীত সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বনীতির প্রমাণ হিসেবে মেনে নিয়েছে। শুধুমাত্র হিন্দুত্ববাদীরাই নন, বিভিন্ন ধর্মীয় নেতারাও তাদের ভাষণে, লেখালেখিতে এই শ্লোকটিকে ব্যবহার করে চলেছেন।
কিন্তু, আধুনিক গণসমাজের ডিসকোর্সে এই বহুচর্চিত শ্লোকটির ব্যবহার হয়ে চলেছে একটা অগভীর, এমন কি বিকৃত ধারণা থেকে। যদি আমরা শ্লোকটির উৎস তথা প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব, এক অপরিসীম অজ্ঞতা ও ভুল ব্যাখ্যা থেকে এই শ্লোকের অর্থ, ব্যঞ্জনা তথা নীতি হিসেবে এর ব্যবহার হয়ে চলেছে।

এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, আমরা ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকের উৎস, তার প্রেক্ষিত এবং নিহিতার্থ অনুধাবন করতে চেষ্টা করব, যা প্রাচীন ঋষিরা বলতে চেয়েছেন।

জনপ্রিয় ধারনা তথা মিথের বিপরীতে বলতে হচ্ছে, এই শ্লোকটি কিন্তু ঋগ্বেদ, বা মহাভারত, বা মনুস্মৃতি, এমন কি পুরাণগুলিতেও নেই। বরঞ্চ, এখনো পর্যন্ত আমরা এই শ্লোকটিকে পাই হিতোপদেশ, পঞ্চতন্ত্র, চাণক্যের সংগ্রহগ্রন্থ, ভর্তহরি, মহাউপনিষদম, বিক্রম-চরিতের কিছু সংগ্রহগ্রন্থ এবং শেষে প্রখ্যাত কাশ্মীরি কবি ভট্ট উদভাতর লেখাতে। এছাড়াও ভবিষ্যতে হয়তো অনেক গ্রন্থে এই শ্লোকটিকে পাওয়া যেতে পারে। তবে এই নিবন্ধে উল্লিখিত টেক্সটগুলি ব্যবহার করেই এই শ্লোকের প্রেক্ষিত নির্ণয় করার চেষ্টা করা হবে।

হিতোপদেশে বসুধৈব কুটুম্বকম

প্রখ্যাত কবি মহাদেবী ভার্মার আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘আমার পরিবার’এর  মুখবন্ধ পড়তে গিয়ে আমি প্রথম এই শ্লোকটির সঙ্গে পরিচিত হই, যা হিতোপদেশের গল্পকথার সংকলন থেকে আহৃত হয়েছে। আধুনিক হিন্দি কাব্যজগতের প্রথিতযশা মহিলা কবি মহাদেবী ভার্মা একজন প্রকৃত পশুপ্রেমী ছিলেন এবং তার বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের পশু পাখির আবাস ছিল, যাদের তিনি তার পরিবারের অংশ হিসেবেই ধরতেন। ওই মুখবন্ধে তিনি এই পশুপাখির পরিবারকে ‘পঞ্চতন্ত্রের উল্লেখিত পশুপাখির এক পরিবার’ হিসেবেই বর্ণনা করেছিলেন। যদিও কবি সম্ভবত হিতোপদেশের কথাই বলতে চেয়েছেন, যা ‘বসুদেব কুটুম্বকম’ শ্লোকের উৎস।

ফ্রেডরিচ ফ্রয়বেল প্রস্তাবিত কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনোদনের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষাদানের প্রস্তাবের বহু শতাব্দীর আগেই এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ভারতে গড়ে উঠেছিল। যদি চিত্তাকর্ষক ও স্মরণযোগ্য গল্পকথার মাধ্যমে শিক্ষা নীতি ও উপদেশগুলিকে অর্থবহ ও উপযুক্ত ভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপনা একটি উদ্ভাবন হিসেবে গণ্য করা যায়, তবে এই শিক্ষা পদ্ধতিকে অবশ্যই প্রাচীন হিন্দুদের একটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হিসেবেই ধরতে হবে এবং হিতোপদেশকে এই পদ্ধতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরতে হবে। এই হিতোপদেশকে সাধারণাব্দীয় পঞ্চম শতকে সম্ভবত মগজ বা বঙ্গদেশে নারায়ণ পন্ডিত সংকলন করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল দুই অমনোযোগী, দুরন্ত রাজপুত্রকে সাধারণ বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গিয়ে উপযুক্তভাবে শিক্ষিত করা।

হিতোপদেশ চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত, যাতে সব গল্পকথাই যেন একটি মধ্যে আরেকটি, তারমধ্যে আরেকটি, এইভাবে শেষে যেন প্রথম গল্পকথা বা কথামুখে ফিরে যাওয়া - সবই একই বৃত্তাকার সূত্রে গাঁথা। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ একমাত্র একবারই প্রথম অধ্যায় ‘মিত্রলাভ’ অধ্যায়ে পাওয়া যায়। হিরণ্যক নামের এক ইঁদুর একটি গল্প বলে তার বন্ধু লঘুপাতনক নামের কাককে, যে গল্পটি হচ্ছে অন্য একটি কাক, এক হরিণ ও ক্ষুদ্রবুদ্ধি  নামের এক শেয়ালের সম্পর্কে। এই গল্পেই ক্ষুদ্রবুদ্ধি শেয়াল এই বিখ্যাত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি বলে, যা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, যখন সেই কাকের কাছ থেকে অন্য একটি গল্প শোনে, যার শিরোনাম ‘জরদগব শকুন ও  দীর্ঘকর্ণ বেড়াল’।

এইভাবে ত্রিস্তরীয় আখ্যানের মাধ্যমে রাজনীতি-প্রাজ্ঞ নারায়ণ পন্ডিত তার ছাত্রদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। সেই জন্য ঐ বিখ্যাত শ্লোকের প্রেক্ষিত বুঝতে গেলে ঐ দুটি গল্প বুঝতে হবে। একটি হচ্ছে সেই গল্প যেখানে শ্লোকটি উল্লেখিত হয়েছে, অন্যটি হচ্ছে সেই শ্লোকের সাপেক্ষে যা বলা হয়েছে। সংক্ষেপে সেই দুটি আখ্যান বলা হচ্ছে।

সুবুদ্ধি কাক, চিত্রাঙ্গ হরিণ এবং ক্ষুদ্রবুদ্ধি শেয়াল

বহু বহুদিন আগে মগধের চম্পকবতী অরণ্যে দুই বন্ধু - চিত্রাঙ্গ নামের এক হরিণ ও সুবুদ্ধি নামের এক কাক বাস করত। একদিন ক্ষুদ্রবুদ্ধি নামের এক শেয়ালের (যাকে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটির প্রস্তাবক হিসেবে পরে দেখা যাবে) যেতে যেতে সুপুষ্ট চিত্রাঙ্গ হরিণের উপর নজর পড়ল। কিম্তু সে জানতো যে, হরিণ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পালাতে পারে। তাই সেই শেয়াল হরিণের আস্থা পেতে এক ফন্দি আঁটলো। শেয়াল প্রথমেই নমস্কার জানালো এবং নতুন আগুন্তুক হিসেবে নিজেকে একা, অসহায় হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলো এবং শেষে হরিণের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে পারল। সরল সাদাসিধে হরিণ শেয়ালের মিষ্ট ভাষণে ভুল করল এবং তার নিজের আস্তানায় শেয়ালকে নিয়ে চলল, বুঝলোই না শেয়ালের প্রকৃত উদ্দেশ্য। হরিণের বাসায় যেতে যেতে পথে দেখা হলো হরিণের পুরনো ও প্রাজ্ঞ বন্ধু সুবুদ্ধি কাকের সঙ্গে। কাক হরিণকে জিজ্ঞাসা করল,  ‘ওহে চিত্রাঙ্গ, তোমার সঙ্গে উনি কে?’ হরিণ উত্তর দিল, ‘আমার নতুন বন্ধু এই শেয়াল’। শুনে কাক জিজ্ঞাসা করল, ‘কিম্তু, তুমি কি ওকে ভালো করে জানো? ভালো করে না জেনেশুনে কাউকে বন্ধু ভাবা ও তাকে আশ্রয় দেওয়া উচিত না’। ঈষৎ কাঁধ নাড়িয়ে হরিণ উত্তর দিল, ‘এই শেয়াল ভায়া খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের’।

বন্ধুর এই অবিমৃষ্যকারিতা দেখে সুবুদ্ধি কাক হরিণকে জরদগব শকুনের গল্প বলা শুরু করলো, যে শকুন মারা গিয়েছিল ভুল করে বিশ্বাস করা এক ভন্ডের জন্য। এইভাবে কাক হরিণকেও সতর্ক করল শেয়ালের ব্যাপারে।

এ পর্যন্ত শেয়ালটি চুপচাপ সব কিছু শুনছিল। এবার সে মুখ খুলল তার যুক্তিজাল নিয়ে। বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি আওড়ে সে  হরিণকে বোঝালো যে, হরিণ যেন ক্ষুদ্রমনা হয়ে কাককেই শুধু বন্ধু ভাবে, আর তাকে বিদেশি অচেনা লোক ভাবে। শঠ, চতুর শেয়াল এই শ্লোকটি ব্যবহার করে হরিণের মন জয় করে নিলো ও তার আস্তানায় চলল।

তাই, গল্পটির সারমর্ম দু’লাইনে বলা যায়। ধূর্ত শেয়াল এইভাবে সরল হরিণের সঙ্গে থাকতে আরম্ভ করল এবং এক সময় সুযোগ বুঝে হরিণকে ফাঁদে ফেলল। অবশ্য হরিণকে মেরে ফেলার আগেই সুবুদ্ধি কাক এক চতুর উপায়ে হরিণকে শুধু বাঁচালোই না, ওই শেয়ালেরও মৃত্যু ঘটালো।

কাজেই নারায়ণ পন্ডিতের উল্লিখিত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটির প্রেক্ষাপট খুবই পরিষ্কার এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে পন্ডিত এই শ্লোকটির ব্যবহারিক মূল্যের কথা বলেছেন। বিশেষ করে, যখন কোন অসৎ ব্যক্তি তা ব্যবহার করে। এই আখ্যানটি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোন আইডিয়াকেই তার পূর্ব ইতিহাস, প্রকৃতি তথা নিহিতার্থ বিচার না করে নির্বিচারে গ্রহণ করা উচিত না।

অবশ্যই হিতোপদেশের অনেক আখ্যানও আমাদের দেখার প্রয়োজন আছে, যেখানে এই শ্লোকটির নিহিতার্থ সম্বন্ধে আর কোন দ্বিধা থাকে না।

জরদগব শকুন ও দীর্ঘ কর্ণ বেড়াল শেয়ালকে বিশ্বাস করার ব্যাপারে সুবুদ্ধি কাক চিত্রাঙ্গ হরিণকে এই আখ্যান শুনিয়ে নিয়ে সতর্ক করল:

ভাগীরথী নদীর পাড়ে গৃধারাকুত নামে এক টিলার ওপর এক বিশাল ডুমুর গাছ ছিল। সেই গাছের কোটরে জরদগব নামের এক বৃদ্ধ শকুন বাস করত। বয়সের কারণে তার দৃষ্টিশক্তি কমে গিয়েছিল আর নখও ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল। ওই গাছে বাসরত অন্যান্য পাখিরা এই শকুনকে ভালোবেসে তাদের খাবার থেকে কিছু অংশ বুড়ো শকুনকে দিত। এইভাবে দিন চলছিল আর বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ পাখিদের বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণ করত ঐ শকুন।

একদিন যখন পাখিরা খাদ্যের খোঁজে দূরে অন্য জায়গায় চলে গেল, তখন দীর্ঘকর্ণ নামের এক বেড়াল খাবারের খোঁজে সেই গাছের তলায় এলো। বেড়ালকে দেখে বাচ্চা-পাখিরা ভয়ে আর্তনাদ করতে শুরু করলো। ফলে, জরদগব শকুন সচকিত হয়ে উঠলো। সে বলে উঠল, ‘কে ওখানে?’ 

এবার বড়ো একটা শকুনকে দেখে বেড়ালটা বুঝল যে, ওই শকুনের সঙ্গে লড়াই করে সে পারবে না। তখন সে একটা নতুন ফন্দি আঁটলো। সে উত্তরে শকুনকে বলল, ‘আর্য, আমার নমস্কার নেবেন’। শকুন জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’ দীর্ঘকর্ণ বলল, ‘আমি একটা সামান্য বেড়াল মাত্র’। শকুন চিৎকার করে উঠল, ‘তফাৎ যাও, বেড়াল। নতুবা আমি তোমাকে হত্যা করব’। বেড়াল উত্তর করল, ‘আমি যদি হত্যার যোগ্য হই, তাহলে আমাকে হত্যা করবেন। কিম্তু, তার আগে দয়া করে আমার কথা শুনুন’। জরদগব প্রত্যুত্তরে বলল, ‘ঠিক আছে। তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্য বলো’।

এবার নাটকীয়ভাবে দীর্ঘকর্ণ বলা শুরু করলো। 'আমি তো গঙ্গার পাড়েই বাস করি। প্রতিদিন গঙ্গা স্নান করে চন্দ্রায়নব্রত পালন করি। ব্রতচারীর মত নিরামিষ ভোজন করি। ওখানে পাখিরা সব আসে, আপনার কথা বলে। আপনি পরম ধার্মিক ও শ্রদ্ধেয়। সেই কারণে আপনার কাছ থেকে নীতি ও ধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করতে আমি খুবই উৎসুক।'

বেড়াল বলে যেতে লাগল, ‘আপনি এত ধর্মনিষ্ঠ যে, আমি বিস্মিত হচ্ছি, আপনি একজন অতিথিকে হত্যা করতে চাইছেন! ধর্মনীতি কি অতিথির সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে হবে, শেখায় না?’ বেড়াল তখন ধর্মশাস্ত্র থেকে এক লম্বা-চওড়া ভাষণ দিলো, যার সারমর্ম শান্তি ও অহিংস!

কিন্তু, জরদগব শকুন তাতে না ভুলে প্রশ্ন করল, 'শোনো ভায়া, আমি শুধু জানি, তুমি একটি বেড়াল, আর বেড়াল মাংসাশী। যেহেতু বাচ্চা-পাখিদের আমি রক্ষা করছি, তাই শেষবারের মতো তোমাকে সতর্ক করছি, এখনি চলে যাও।'

এই শুনে দীর্ঘকর্ণ বেড়াল আরো নাটকবাজি শুরু করলো। ভূমিতে সাষ্টাঙ্গ হয়ে দেবতাদের নামে শপথ নিয়ে বলল, 'চন্দ্রায়ণব্রত পালন করে আমি সমস্ত আসক্তির উর্ধ্বে উঠেছি, শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, অহিংসা ধর্ম পালন করছি।'

এইভাবে নাটক করে শকুনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বেড়াল শেষে সেই গাছের কোটরে থাকতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে শকুনের বিশ্বাস অর্জন করে শেষে বেড়াল তার আসল কাজ শুরু করলো, বাচ্চা-পাখিদের একে একে খেতে শুরু করল, আর হাড়গুলো শকুনের কোটরে ফেলতে থাকল।

একের পর এক বাচ্চাদের নিখোঁজ হওয়ার পর একদিন বাচ্চাদের মা-বাবা পাখিরা তাদের খোঁজ করা শুরু করল। চতুর বেড়াল তখন নিঃশব্দে পালিয়ে গেল, আর পাখিরা দেখল তাদের বাচ্চাদের হাড়গোড় জরদগব শকুনের কোটরে পড়ে রয়েছে। তারা তখন এই সিদ্ধান্তে এলো, বুড়ো শকুনই এসব কাণ্ড ঘটিয়েছে। ফলে, যা হবার তাই হল। প্রকৃত বন্ধু  হয়েও নিজের ভুলের কারণে পাখিদের হাতে শকুনের প্রাণ গেল।

হিতোপদেশের উপরের আখ্যানটি হচ্ছে সেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটির উৎস যা সাবভারসনিষ্টরা ব্যবহার করে চলেছে।

এতোক্ষণে আমাদের কাছে পরিস্কার যে, প্রাচীন আচার্য নারায়ণ পন্ডিত তার ছাত্রদের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বনীতিকে অন্ধ ভাবে মেনে চলার শিক্ষা দেন নি, বরং উল্টো ভাবে এই আদর্শ নীতিকে অন্ধ ভাবে ব্যবহারের নীতির বিপক্ষেই সতর্ক হতে বলেছেন। কিম্তু, আধুনিক ভারতের নীতিনির্ধারকরা ও তাদের অনুসারীরা নারায়ণ পণ্ডিতের সতর্কবাণী উপেক্ষা করেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটিকে নীতি হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন।
(প্রথম পর্ব শেষ)

ড. সুজিৎ রায়

No comments:

Post a Comment