নির্বাচনে ভোটারের সাধারণ বিবেচনাবোধ


পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধান গণতান্ত্রিক প্রথা – নির্বাচন শেষ হলো। ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ এক অভূতপূর্ব গণতান্ত্রিক বিজয়ের সাক্ষীস্বরূপ হয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিলো। মাননীয় শ্রীনরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি আসমুদ্রহিমালয়ের জনাদেশ নিয়ে পুনরায় ভারত-শাসনের প্রতিনিধিত্ব অর্জন করলো। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ছিল ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে। আর ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মোদি সরকার ছিল ক্ষমতা ধরে-রাখার লড়াইয়ে। এখানেই প্রশ্ন, সাধারণ ভোটার কি ভেবে, কি অংক কষে, কি লাভ-ক্ষতির হিসাবে মোদি সরকারকে পুনরায় বিপুল ভোটে ফিরিয়ে নিয়ে এলো?

এখানেই সাধারণ মানুষের সাধারণ বিবেচনাবোধ বা কমন সেন্স কিভাবে সিদ্ধান্ত-গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে তার বিশ্লেষণ আবশ্যক। প্রথমেই বলা দরকার, সাধারণ মানুষ কিন্তু কোনো একশিলীভূত মনোলিথিক ধারণা নয়। এক সাধারণ মানুষের মধ্যেই অনেক ধরনের খন্ড-পরিচয়সত্তা অন্তর্লীন হয়ে আছে। এক মানুষ একই সঙ্গে লিঙ্গ পরিচয়ে নারী/পুরুষ/তৃতীয় লিঙ্গ; জাতিবর্ণভেদে দলিত/ওবিসি/বর্ণহিন্দু; ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু/মুসলমান/শিখ/খ্রিস্টান/বৌদ্ধ; ভাষাভেদে বাংলাভাষী/হিন্দিভাষী/তামিলভাষী ইত্যাদি; আঞ্চলিক পরিচয়ে অসমিয়া/বাঙালি/ওড়িয়া/বিহারী/গুজরাটী/তামিল ইত্যাদি। আবার এই সাধারণ মানুষই বংশ-পরিবার ভেদে আলাদা সত্তা। সেই সঙ্গে বয়স ভেদে যুব/প্রৌঢ়/বৃদ্ধ। কাজ-পেশা ভেদে কেউ কৃষক/শ্রমিক/ব্যবসায়ী/চাকুরে। আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কেউ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত। এরই সঙ্গে আইডিওলজি বা মতাদর্শগত পরিচয়ও আছে। আবার এক রাষ্ট্রগত পরিচয় আছে এই সাধারণ মানুষের। এইসব নিয়েই প্রতিটি সাধারণ মানুষ অনেক ধরণের খন্ড-পরিচয়সত্তার এক মিশ্রিত অখন্ড সত্তাবিশেষ। সেখানেই প্রশ্ন, এক সাধারণ ভোটার পছন্দ করার সময় বিভিন্ন খন্ড-পরিচয়সত্তার সাপেক্ষে কিভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন?

এখানেই একটা প্রশ্ন ওঠে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় মানুষ কি সমস্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি, সব কারণ, ফ্যাক্টরগুলোকে বিচার বিশ্লেষণ করতে পারে বা সুযোগ পায়? নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রবিদ তথা মনস্তত্ত্ববিদ হারবার্ট সিমোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার ‘সীমাবদ্ধ যৌক্তিকতা’ তত্ত্ব – Bounded Rationality Theory এবং ‘সন্তোষকারক’ তত্ত্ব – Satisfysing Theory অবতারণা করেছিলেন। অর্থাৎ মানুষ কোনো ক্ষেত্রেই কোনো সময়েই কোনো বিষয়েই সব ধরনের কারন/ফ্যাক্টর জানতে পারে না। তাই পুরোপুরি যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হতে পারে না। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই সন্তোষকারক সিদ্ধান্ত নেয়। এখন প্রশ্ন, একজন ভোটার  কি কি কারণে কোনো দল/ব্যক্তিকে ভোট দেয় বা না দেয়?

আরেক বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ আব্রাহাম মাসলোর ‘প্রয়োজনের হায়ারার্কি তত্ত্ব -  Need Hierarchy Theory সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভোটারের মানসিকতা বুঝতে সাহায্য করে। এই তত্ত্বানুযায়ী, মানুষের বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনের পিরামিড-ভিত্তিক কাঠামোর বেস/সর্বনিম্ন স্তরে আছে মানুষের জৈব চাহিদা পূরণের প্রয়োজন। তারপর ধাপে ধাপে অন্যান্য প্রয়োজন-পূরণের চাহিদা – সুরক্ষার চাহিদা, সামাজিক সম্পর্ক-স্থাপনের চাহিদা, সম্মানলাভের চাহিদা, আর শেষে সেল্ফ-অ্যাকচুয়ালাইজেশন যেখানে মানুষের বাইরের কোনো চাহিদা পূরণের আকাঙ্ক্ষা নেই। এর সঙ্গেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পুশ ও পুল ফ্যাক্টর কাজ করে। পুশ ফ্যাক্টর হলো সেই সব ফ্যাক্টর যেগুলো একজন মানুষকে আগের পছন্দগুলো থেকে সরিয়ে দেয়। আর, পুল ফ্যাক্টর মানুষকে নতুন পছন্দগুলোর দিকে নিয়ে যায়।

এই তিন ধরনের প্যারাডাইম তথা প্রেক্ষাপটে – সীমাবদ্ধ যৌক্তিকতা ও সন্তোষকারকতা, বিভিন্ন স্তরের চাহিদা পূরণ এবং পুশ-পুল ফ্যাক্টর – এইসব নিয়েই একটা ‘পারসেপশন’ গড়ে ওঠে যা মোটামুটি একজন সাধারণ মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে। এখন সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে সাধারণ ভোটাররা যেভাবে মোদি সরকারকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো, সেই সাধারণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কারণ বিশ্লেষণ করলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আমরা বুঝতে পারবো।

ভারতে তিন ধরনের নির্বাচন হয় – জাতীয় সাধারণ নির্বাচন, রাজ্য নির্বাচন আর স্থানীয় পঞ্চায়েত/পৌরসভা নির্বাচন। প্রশ্ন হলো, সাধারণ ভোটার কি তিন ধরনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মাপকাঠি ব্যবহার করে? এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এবারের নির্বাচনে দেখা গেল, সাধারণভাবে সাধারণ ভোটার সেরকমই ভেবেছে। এই সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গেই কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে একই ভোটার/নির্বাচক দুই ক্ষেত্রে দুরকম ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ সাধারণ ভোটার জাতীয় ইস্যু ও আঞ্চলিক ইস্যুর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাই, জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয়তাবোধ, ভারতীয় জাতিসত্তা – এসবের ক্ষেত্রে মোদিজির সদর্থক ভূমিকা পুল-ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে। উরি, বালাকোট, অভিনন্দনের প্রত্যার্পণ – সব নিয়েই জাতীয়-স্বার্থে মোদিজির অথরাইটেটিভ নেতৃত্বদানের ক্ষমতাতে যে ইতিবাচক ধারণা তৈরী হয়েছিল, তাতে মানুষের মনে একদিকে যেমন জাতীয়ভাবে সুরক্ষার চাহিদা পূরণ হয়েছিল, অন্যদিকে পাকিস্তানের সাপেক্ষে ভারতীয় নাগরিকদের ‘সামূহিক অহংবোধের’ পরিতৃপ্তি হয়েছিল।

এবার আসা যাক সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে মোদী সরকারের ভূমিকা। ২০১৪ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে মোদিজি সাধারণ মানুষকে এক অবাক-করা আর্থিক প্রকল্প উপহার দিয়েছিলেন – জনধন যোজনা, সঙ্গে বীমা প্রকল্প। সাধারণ মানুষ সার্বিকভাবে এই প্রথম ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হলো। তারপর, বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প চালু হল, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত – খাদ্য, শৌচালয়, বাড়ি, বিদ্যুৎ, জল, রাস্তা, গ্যাস, স্বনিযুক্তি কর্মপ্রকল্পের জন্য ঋণ ব্যবস্থা ইত্যাদি। এরসঙ্গে আধার প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি সাহায্য সরাসরি অ্যাকাউন্টে ঢোকা মানুষের মনে মোদি সরকারের ইতিবাচক ভূমিকাকেই পোক্ত করেছে। তার সঙ্গে শেষবেলায় স্বাস্থ্য বীমা, কৃষককে সরাসরি অর্থসাহায্য, কৃষক-শ্রমিকদের জন্য পেনশন প্রকল্প - সবমিলিয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ সম্মানজনক জীবন-নির্বাহের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাকে সদর্থক হিসাবেই নিয়েছে।

এর পরের স্তরে আসে সামাজিক সম্পর্ক-স্থাপনের চাহিদা পূরণের কথা। ডিজিটাল ইন্ডিয়া আজ সকল স্তরের মানুষকেই এক মুক্ত সমাজের আবহে প্রবেশ করিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমকে মোদিজি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক-স্থাপনের ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন, যা আপামর জনসাধারণকে মোদি সরকার সম্বন্ধে ইতিবাচক ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। এ সবই পুল ফ্যাক্টর।

এরপরেই দুটি প্রধান ঘটনা – নোটবন্দী ও জিএসটি। সাধারণ ভোটারের কাছে নোটবন্দীর অসুবিধার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে নরেন্দ্র মোদির দুর্নীতির বিরুদ্ধে সার্বিক লড়াইয়ের বার্তা এবং একই সঙ্গে গরীব-বড়লোককে একই লাইনে দাঁড় করানোর ক্ষমতা। এখানেই যেন সাধারণ মানুষ এক নৈতিক জয় পেল। জিএসটির ক্ষেত্রেও একই কথা। সাধারণ মানুষ মনে করল, জিএসটির জন্য ব্যবসায়ীরা কালো খাতা বন্ধ করতে বাধ্য হবে, সৎ ভাবে ব্যবসা করবে। এটাও সাধারণ মানুষের কাছে একধরনের নৈতিক জয়। এগুলো মানুষের অহং পরিতৃপ্তির কারণ। এইসব পুল-ফ্যাক্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোদিজির সদর্থক দুর্নীতিমুক্ত সরকার চালানোর ক্ষমতা তথা রাজর্ষিসুলভ তার ব্যক্তিগত জীবনযাপন। আজকের সমাজে সেল্ফ-অ্যাকচুয়ালাইজেশনের প্রতিমূর্তি হলেন শ্রীনরেন্দ্র মোদি, যিনি সনাতন ভারতের স্বরূপবিশেষ রূপে সাধারণ ভোটারের কাছে প্রতীয়মান হয়েছেন।

এখানেই পুশ-ফ্যাক্টরের ভূমিকা আসে। যখনই পছন্দের কথা আসে, তখনই সাধারণের মনে আসে প্রথম প্রশ্ন, বিকল্প কে? সত্যিই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে, সাধারণ ভারতীয় ভোটার কোনো বিকল্প নেতা পায়নি, যার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা মোদিজির থেকে বেশি। রাফেল দুর্নীতির অভিযোগ টেকেনি। কারণ, সাধারণ মানুষ বুঝেছে রাফেল ডিলে কোন দালাল ছিল না, আর সুপ্রিম কোর্ট কোন অসংগতি পায়নি। সেই জন্য চৌকিদার চোর - এই ন্যারেটিভ মানুষ মেনে নেয়নি।

এর সঙ্গে অন্য পুশ ফ্যাক্টর হলো, বিরোধীদের স্ববিরোধী জোট যার একমাত্র ভিত্তি হলো ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদির বিরোধিতা করা ও তাকে অনবরত ব্যক্তি-আক্রমণ করা। একই সঙ্গে বিরোধী পক্ষের কোনো সদর্থক ভিশন না থাকাও মোদিজির পক্ষে ইতিবাচক হয়েছে। বিরোধীপক্ষ স্বপ্ন দেখাতেও ব্যর্থ।

এসবের সঙ্গে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহজির সাংগঠনিক দক্ষতা তথা বিজেপি কর্মীদের নীরবে মাটি কামড়ে লড়াই করে যাওয়া সাধারণ ভোটারের কাছে পুল-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে কোন কোন রাজ্য, বিশেষ করে বাংলায়, আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্ব তথা কর্মীদের ঔদ্ধত্য ও দুর্নীতি সাধারণ ভোটারের কাছে পুশ-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। ফলস্বরূপ, সাধারণ ভোটারের সাধারণ বিবেচনাবোধের স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রীনরেন্দ্র মোদির এই ঐতিহাসিক জয়!

@ সুজিৎ রায়



5 comments:

  1. খুব সুন্দর ভাবে নির্বাচন সম্পর্কে বিশ্লেষণ করলে।ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  2. 🙏 অনুরোধ করছি, যারা মতামত দিচ্ছেন তারা পরিচয় দেবেন। নাহলে বুঝতে পারছি না।

    ReplyDelete