ধর্মনিরপেক্ষতা ও কিছু প্রশ্ন

ধর্মনিরপেক্ষতা - এই শব্দবন্ধটি আধুনিক ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এমন একটি বহুচর্চিত বিতর্কিত বিষয়, যার ব্যাপ্তি ও অভিঘাত আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরেই বিভিন্ন সামাজিক কাঠামোজনিত সম্পর্কগুলিকে প্রভাবিত করে চলেছে। প্রাচীন তথা মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজে এই ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির ব্যবহার ছিল না। তাহলে শব্দটি কিভাবে চালু হলো ভারতীয় সমাজে? ইংরেজি 'সেকুলার' শব্দের ভাষান্তর/ভাষানুবাদ হিসাবেই 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি চালু হয়েছে। সেই সঙ্গে 'সেকুলারিজম' অর্থে 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ' চালু হয়েছে।

এখানেই ভাষা এবং সামাজিক-বাস্তবতার (সোশ্যাল-রিয়েলিটি) পারস্পরিক গতিশীল সম্পর্কের বহুমাত্রিকতার ব্যাপারটি বুঝে নেওয়া দরকার। ভাবের বাহন ভাষা, আর ব্যাক্তি-মানুষ, গোষ্ঠী-মানুষ (কমিউনিটি) ও বৃহত্তর জনসমাজের (পাবলিক সোসাইটি) পারস্পরিক সম্পর্কের ফসলই ভাব। এই ভাব ও ভাষার পারস্পরিক গতিশীল সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই বাইরের ভূ-প্রাকৃতিক জগতের প্রেক্ষাপটে এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর বিশেষ জীবনধারা 'বিশিষ্ট রূপ' পায়। সেখানেই প্রশ্ন, এক সমাজের জীবনধারাগত সামাজিক-বাস্তবতা দ্বারা আরেক সমাজের সামাজিক-বাস্তবতাকে কতোদূর পর্যন্ত ব্যাখ্যা করা যায়, বা 'ফিট করানো' যায়? এটি কিন্তু 'ধান ভানতে শিবের গীত' গাওয়া নয়! এটুকু গৌড়চন্দ্রিকা না করলে আমরা মূল প্রশ্নে ঢুকতে পারবো না।

এখন, সেকুলারিজম ভাষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হয়েছে, যাতে 'ইজম' বা 'বাদ' যুক্ত হয়েছে। ইজম একটি বিশেষ ধরনের বা প্যাটার্নের চিন্তাধারাকে বোঝায়, যা মূলত একদেশদর্শী এবং জনগোষ্ঠীকে সেই বিশেষ চিন্তাধারা তথা জীবনচর্চায় দীক্ষিত করে। ফলে সেই জনগোষ্ঠী তথা অন্তর্ভুক্ত ব্যাক্তি-মানুষের এক বিশেষ বিশ্ববীক্ষা (Worldview) গড়ে ওঠে। সেই প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় সমাজ-ব্যবস্থায় সেকুলারিজম বলতে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ও রিলিজিয়াস-ব্যবস্থার পরস্পর থেকে বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতা বোঝায়, যেখানে রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো রাষ্ট্র-ধর্ম (স্টেট রিলিজন) নেই এবং রাষ্ট্র-পরিচালনায় রিলিজনের কোনো ভূমিকা নেই। সেখানে রিলিজন ও সেকুলারিজম পরস্পরের বিপরীত অর্থ বোঝায়। সেই সামাজিক-বাস্তবতা কি ভারতীয় সমাজে দেখা যায়?

আমরা জানি, প্রতিটি শব্দ তথা বাক্যের অনেক দিক (ডাইমেনশন) থাকে। প্রধান দুটি দিক - বাক্যার্থ (meaning) ও নিহিতার্থ (point) - সব নিয়েই প্রতিটি শব্দ/বাক্য প্রেক্ষিত-সাপেক্ষ (contextual), যা জীবনধারার পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। কিন্তু, ধর্ম শব্দটির সে রকম পরিবর্তন হয়েছে? ধর্ম - 'ধৃ' ধাতু/মূলের সঙ্গে প্রত্যয় যোগ করে হয়েছে - 'যা ধরে রাখে'। তাই ধর্মের পরিবর্তন হতে পারে না। যেমন, জলের ধর্ম 'জলত্ব'। সেই জলত্ব যদি পরিবর্তিত হয়, তবে জল আর জল থাকে না। মানুষের ক্ষেত্রে এই ধর্ম অবশ্যই 'মনুষ্যত্ব' - 'মানুষের ধর্ম'! এই মনুষ্যত্ব কি, সেটাই মূলপ্রশ্ন। সেখানেই ধর্মের সামাজিক ব্যঞ্জনা।

ভারতীয় জীবনধারায় প্রতিটি মানুষই 'ধার্মিক'। তাই মানুষ 'অধার্মিক' আচরণ করতে পারে, কিন্তু 'ধর্ম-নিরপেক্ষ' হতেই পারে না। ধর্মের বিপরীতে 'অধর্ম', যা ধর্মসম্মত নয়, ধর্ম অস্বীকার করে; কিন্তু কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ নয়। একইভাবে, ধর্মের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'রিলিজন' হতে পারে না। কারণ, রিলিজন শব্দটি ধর্মের ব্যাপ্তি, গভীরতা তথা ব্যঞ্জনাকে ধরতেই পারে না। রিলিজন বলতে পাশ্চাত্য আব্রাহামীয় একেশ্বরবাদী বিশেষ ধরনের 'বিশ্বাস' তথা 'নির্দিষ্ট' ধরনের উপাসনা-পদ্ধতি ব্যবস্থাকে বোঝায়। সেখানে রিলিজনের বিপরীতে areligion, anti-religion, irreligion শব্দগুলো ব্যবহৃত হয় না, বরং ব্যবহৃত হয় সেকুলার শব্দটি। সেখানে রিলিজন অর্থে অন্য জীবন, অপার্থিব জীবনকে বোঝায়‌; আর, সেকুলার অর্থে ইহজীবন, পার্থিব জীবন বোঝায়।

কিন্তু, ভারতীয় ধার্মিক জীবনধারায় ইহজীবন ও পরজীবন যেন একই জীবনের দুই পিঠ, পরস্পর সম্পৃক্ত, অবিভাজ্য। সেখানেই ঋকবেদীয় ধারণা 'ঋতধর্ম' এই জীবনধারায় এক বিশেষ অর্থ বহন করে চলেছে, যা জগৎ, জীবন ও সমাজ-জীবনকে নিয়ে এক সামগ্রিক বিশ্বজাগতিক শৃঙ্খলাকে বোঝায়। এখানেই সত্য ও মায়া - এই দুটি ধারণা জড়িত। 'সত্য' - যা অস্তিময়, যা আছে, যা নিত্য, যা শৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত, যা সুষমাময়। তাই সত্যধর্ম সেই ঋতধর্মেরই অংশ। আর, 'মায়া' - যা অনিত্য, যা শৃঙ্খলাহীন, যা ভ্রান্ত, যা সত্যকে ঢেকে রাখে। তাই, মায়া অধর্মেরই প্রতিরূপ। কাজেই, রিলিজনের বিপরীতে সেকুলার বলতে যা বোঝায়, ধর্মের বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা তা বোঝায় না। কারণ, আভিধানিক অর্থেও ধর্ম-নিরপেক্ষতা কখনোই ধর্মহীনতা বা ধর্মবিরুদ্ধতা বোঝায় না। তাই, ভারতীয় জীবনধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি অনেকটা 'সোনার পাথরবাটী'র মতো!

আবার, আধুনিক ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনা-ব্যবস্থাতেও ধর্ম-ব্যবস্থা ও শাসন-ব্যবস্থার মধ্যে কোনো বিভাজন করা হয়নি। ভারত রাষ্ট্র প্রতিটি ধর্মবিশ্বাস ব্যবস্থাকে সমানভাবে মান্যতা দিয়েছে এবং প্রতিটি ধর্মবিশ্বাস-গোষ্ঠীর 'নিজস্ব গোষ্ঠীগত বিধিব্যবস্থা'কে (পারসোনাল আইন বিধি) মান্যতা দিয়েছে। ইউরোপীয় সেকুলারিজমের ধর্ম-প্রয়োজনহীনতার প্রয়োগকে ভারতে মান্যতা দেওয়া হয়নি। এখানে ব্যক্তি-মানুষ গোষ্ঠীধর্মবিশ্বাসের বাতাবরণে জীবনাচরণ করে চলেছে। এমনকি, রাষ্ট্রও বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন শাসনধারা জারি রেখেছে। তাই, ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা আর প্রয়োগ ইউরোপীয় সেকুলারিজমের মতো নয়।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে, সেকুলারিজমের প্রায়োগিক ভাষান্তর কি হতে পারে? রিলিজন যেমন ধর্ম নয়, সেকুলারিজম তেমনি ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। তবে রিলিজনকে যদি 'ধর্মবিশ্বাস' বলা যায়, সেকুলারিজমকে 'ধর্মবিশ্বাস-নিরপেক্ষতা' হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাই, ব্যাপক অর্থে ধর্মের পাশাপাশি রিলিজনকে নির্দিষ্ট অর্থে 'ধর্মবিশ্বাস' হিসাবে এবং সেকুলার অর্থে 'ধর্মবিশ্বাস-নিরপেক্ষতা' শব্দটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

আমার এই লেখাটি 'যুগশঙ্খ' খবরের কাগজে ১০ মে ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে।

@ সুজিৎ রায়


No comments:

Post a Comment