বিধান পরিষদ: এক অচল ব্যবস্থা

এই প্রবন্ধটি 'স্বস্তিকা' পত্রিকায় ২০ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। 


ভারতীয় সংবিধানের ১৬৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক রাজ্যে বাধ্যতামূলকভাবে রাজ্যের ভোটারদের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত একটি বিধানসভা থাকতেই হবে, এবং ঐচ্ছিক হিসাবে পরোক্ষ ভাবে নির্বাচিত এক বিধান পরিষদ থাকতে পারে। অনেকে মনে করেন, বিধানসভা কেন্দ্রীয় ভাবে সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার মতো; আর বিধান পরিষদ অনেকটা সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার মতো। বর্তমানে সারা ভারতে মাত্র ছয়টি রাজ্যে বিধান পরিষদ আছে। এগুলি হলো: অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, বিহার ও উত্তর প্রদেশ। 

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সংবিধানের ১৬৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাজ্যে বিধান পরিষদ গঠন করার জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এই রাজ্যে ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটি বিধান পরিষদ ছিল। বর্তমান মমতা ব্যানার্জি সরকার পুনরায় সেই বিধান পরিষদ তৈরি করার জন্য প্রস্তাব পাশ করেছে; যদিও সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় নি। বিধান সভার একমাত্র বিরোধী দল বিজেপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। 

এখন কিছু মূল প্রশ্ন: বিধান পরিষদকে কি রাজ্যসভার রেপ্লিকা বলা যায়? এই পরিষদ কি রাজ্যস্তরে প্রতিনিধিত্বমূলকতা মেনে তৈরি হয়? এই বিধান পরিষদ কতোটা জরুরি বা প্রয়োজনীয়? এই ইস্যুগুলি নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক।

প্রাচীন কালের মতো কিছু কিছু দেশে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নীতি মেনে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা আজকের সময়ে অবাস্তব। আজকের পরিস্থিতিতে তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় পরোক্ষভাবে, যার ভিত্তি ভূমি হচ্ছে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, যেখানে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচকমন্ডলী তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে। ভারতেও এই শাসনব্যবস্থাই গৃহীত হয়েছে। গঠনগত ভাবে ভারত রাষ্ট্র একটি ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় একীভূত সত্তা’ (ফেডারাল ইউনিয়ন), যার দ্বি-কক্ষীয় সংসদ আছে- সরাসরি ভারতীয় নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত নিম্নকক্ষ ‘লোকসভা’ এবং পরোক্ষভাবে রাজ্যের বিধানসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত উচ্চকক্ষ ‘রাজ্যসভা’। যদিও ভারত একটি ‘রাজ্যগুলির ইউনিয়ন’, কিন্তু ভারতের রাজ্যগুলি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলির মতো নয়। কারণ, আমেরিকার রাজ্যগুলির মতো কোনো চুক্তিবদ্ধ নীতির মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্র তৈরি হয় নি। ভারতে রাজ্যগুলি কোনো অপরিবর্তনীয় কাঠামোগত সত্তা নয়। তাছাড়াও ভারতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা আছে রাজ্যগুলির সীমানা পরিবর্তন করা, এক বা একাধিক রাজ্য ভেঙে বা জোড়া দিয়ে নতুন রাজ্য গঠন করা ইত্যাদি। এছাড়াও ভারতীয় নাগরিকত্ব একক, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দ্বিত্ব নয়।

তবে, যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি মেনে ভারতীয় সংবিধানের রূপকারগণ রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাজ্যসভার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু, বিধান পরিষদকে কখনোই রাজ্যসভার রেপ্লিকা হিসাবে দেখা যায় না। তার অনেক কারণ আছে। জনসংখ্যার অনুপাতে গঠিত রাজ্য বিধানসভার সদস্যদের ভোটে রাজ্যসভা গঠিত হয়েছে; যদিও বিধান পরিষদের সদস্যরা সেই নীতির উপর ভিত্তি করে নির্বাচিত হন না। রাজ্যসভার ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বমূলকতার ভিত্তিভূমি হচ্ছে রাজ্য। বিধান পরিষদের ক্ষেত্রে এরকম কোনো ভিত্তিভূমি নেই। আবার, রাজ্যসভা একটি স্থায়ী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিধান পরিষদ কোনো স্থায়ী প্রতিষ্ঠান নয়; ভারতীয় সংসদ এই প্রতিষ্ঠানকে ১৬৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তৈরি বা অবলুপ্ত করতে পারে। এখানেই একটি মূল প্রশ্ন: রাজ্য বিধানসভার গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের সংসদ কি ‘বাধ্যতামূলক’ ভাবে বিধান পরিষদকে তৈরি/অবলুপ্ত করতে পারে? 

শুধু তাই নয়, ১৭১(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভারতের সংসদ সাধারণ আইন তৈরি করে বিধান পরিষদের গঠনগত পরিবর্তন করতে পারে, যা বিশেষ ভাবে সংবিধান সংশোধন না করে রাজ্যসভার ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। আবার, রাজ্যসভার ক্ষমতার সঙ্গে বিধান পরিষদের ক্ষমতার তুলনাই হয় না। যদিও অর্থ বিলের ক্ষেত্রে রাজ্যসভা ও বিধান পরিষদ দুয়েরই কোনো ক্ষমতা নেই; কিন্তু অর্থ-সংক্রান্ত বিলের ক্ষেত্রে রাজ্যসভার মতো বিধান পরিষদের কোনো ক্ষমতা নেই। এছাড়াও সাধারণ বিলের ক্ষেত্রে রাজ্যসভার যে ভূমিকা আছে, বিধান পরিষদের সে ক্ষমতাও নেই। কারণ, কোনো বিল রাজ্য বিধানসভা যদি দ্বিতীয় বার পাশ করে, তবে বিধান পরিষদের কোনো ক্ষমতাই নেই সেই বিলকে কোনো ভাবে আটকে রাখা বা পাশ না করা। রাজ্যসভাকে লোকসভার প্রায় ‘সমান’ ক্ষমতা-সম্পন্ন বলাই যায়; কিন্তু, রাজ্য বিধান পরিষদকে কোনো ভাবেই বিধানসভার সমান বলা যায় না। শেষে এটাও বলতে হয় যে, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে রাজ্যসভার যে ক্ষমতা আছে, বিধান পরিষদের তার বিন্দুমাত্র নেই। তাই, বিধান পরিষদ কোনো ভাবেই রাজ্যস্তরে রাজ্যসভার রেপ্লিকা নয়।

এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: রাজ্য স্তরে বিধান পরিষদ প্রতিনিধিত্বমূলকতার নীতিকে কতোটা মেনে চলে? এটা অস্বীকার করা যায় না যে, ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি যেন রাজ্যগুলির সীমানাতেই শেষ হয়েছে। রাজ্যের অভ্যন্তরে বিধান পরিষদ কোনো যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি মেনে তৈরি হয় না। অর্থাৎ, জেলাগত বা কোনো বিশেষ ভৌগোলিক এলাকার প্রতিনিধিত্ব বিধান পরিষদে হয় না। বিভিন্ন ধরনের নির্বাচকমন্ডলী, যেমন, বিধায়ক-মন্ডলী, স্থানীয় স্বশাসিত বোর্ডগুলি, স্নাতক-মন্ডলী, শিক্ষক-মন্ডলী দ্বারা বিভিন্ন অনুপাতে নির্বাচিত সদস্য ও রাজ্যপালের মনোনীত সদস্যদের নিয়ে বিধান পরিষদ গঠিত হয়, যার কোনো যুক্তি-সংগত প্রতিনিধিত্বমূলকতা নেই। বিধান পরিষদের গঠন রাজ্যের অধিবাসীদের সাপেক্ষে নিশ্চিতরূপে এক অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। 

ভারতের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিধান পরিষদ কতোটা প্রয়োজনীয়? জনগণের অর্থ দিয়ে এইধরনের অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে চালু রাখা বা নতুন করে তৈরি করা কতোটা প্রয়োজনীয়? বিধান পরিষদের অকার্যকারিতা এতোটাই প্রকট যে, এই ব্যবস্থা জন সময়, অর্থ ও শ্রমের অপচয়ের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবিধান তৈরির সময় এই প্রতিষ্ঠানের যা কিছু প্রাসঙ্গিকতা ছিল, আজকের সময়ে তা আর নেই; এই সাংবিধানিক ব্যবস্থা এখন অচল হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বমূলকতার পরিপন্থী এই ব্যবস্থা এখন যে কোনো শাসক দলের কাছে এক রাজনৈতিক কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে; যা আমরা দেখলাম পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ এখানে শাসক দলের প্রধান অস্ত্রে পরিণত হয়েছে।   

তাই এখনই সেই সময়, যখন বিধান পরিষদ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে এক সাহসিক পদক্ষেপ নেওয়া। এ ব্যাপারে এক সার্বিক রাজনৈতিক ঐক্যমত্য গড়ে তোলা দরকার। সংবিধান সংশোধন করে হয় বিধান পরিষদ ব্যবস্থাকে বাতিল করা দরকার, নতুবা এই প্রতিষ্ঠানকে সর্বার্থে প্রতিনিধিত্বমূলক করে তোলা দরকার যার ভিত্তিভূমি হবে জেলা ও অন্যান্য ভৌগোলিক এলাকা। সংবিধানের ১৭১(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিধান পরিষদের সদস্যতার ক্ষেত্রে এক নতুন আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা সংসদের আছে। তবে ভারতের মতো এক ভাইব্রান্ট গণতন্ত্রে বিধান পরিষদের মতো এক অগণতান্ত্রিক অচল ব্যবস্থাকে অবলুপ্ত করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। 

@ ড. সুজিৎ রায়

No comments:

Post a Comment

Emerging Horizons For Women Entrepreneurship: A Sociological Enquiry

Ebook of my PhD Thesis "Emerging Horizons For Women Entrepreneurship: A Sociological Enquiry" is now in public domain after ten ye...