বহুমুখী যুদ্ধে ভারত

'বহুমুখী যুদ্ধে ভারত: জাতীয় সুরক্ষা নীতির রূপরেখা'- আমার এই নিবন্ধটি 'বঙ্গদেশ' নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে।https://www.bangodesh.com/2020/12/national-security-policy-doctrine/

ভারত সত্যিই এক বহুমুখী যুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লীনতাপ ও স্পর্শগ্রাহ্য তাপের মতো যুদ্ধও দু'রকম: অঘোষিত যুদ্ধ ও ঘোষিত যুদ্ধ। ভারত-চিন সীমান্ত জুড়ে 'প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায়' (এলএসি) যা চলছে তা এক অঘোষিত যুদ্ধ। তবে ভারতের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ যেমন চলছে লাদাখে ও এলএসির বিভিন্ন এলাকায়, ঠিক তেমনি তা চলছে ভারত-পাক 'নিয়ন্ত্রণ রেখায়' (এলওসি)। শুধু তাই নয়, অঘোষিত যুদ্ধ চলছে সীমান্ত ছাড়াও দেশের ভেতরেও। চলছে সংঘটিত ধর্মীয় মৌলবাদী হিংসাত্মক অন্তর্ঘাতমূলক সন্ত্রাস। সঙ্গে আছে মাওবাদীদের গেরিলা আক্রমণ আর উত্তর-পূর্বের কিছু অংশে বিদ্রোহীদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ। এসবের সঙ্গেই যুক্ত আছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র, যা গড়ে উঠেছে সোনা-পাচার, মাদক-পাচার, গরু-পাচার তথা নারী ও শিশু-পাচারকে কেন্দ্র করে। আর, সঙ্গে তো বিদেশী দান-চক্রের গোপন এজেন্ডা আছেই।


এইসব অঘোষিত যুদ্ধের অনেক দিকের মধ্যে যেমন আদর্শগত যুদ্ধের দিক আছে, তেমনি কৌশলগত দিকও আছে। তাই ভারতকে বহুমুখী যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একদিকে অঘোষিত যুদ্ধের মোকাবিলা, অন্যদিকে ঘোষিত যুদ্ধের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকা। এসবের প্রেক্ষাপটেই ভারতের এক জাতীয় সুরক্ষা নীতির সম্ভাব্য রূপরেখার উপর আলোকপাতের প্রচেষ্টা।


প্রথমেই বলা দরকার, এখনো পর্যন্ত ভারতের কোনো 'জাতীয় সুরক্ষা নীতি' প্রকাশিত হয়নি। ২০০৭ সালে ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স স্টাফ যে খসড়া 'জাতীয় সুরক্ষা কৌশল' (ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্রাটেজি) তৈরি করেছিল, তা তখনকার ভারত সরকারের 'সুরক্ষা-সংক্রান্ত ক্যাবিনেট কমিটি' অনুমোদন করেনি। পরে মোদী সরকার ২০১৮ সালে নতুনভাবে 'সুরক্ষা পরিকল্পনা কমিটি' (ডিফেন্স প্ল্যানিং কমিটি-ডিপিসি) তৈরি করেছে, যার নেতৃত্বে আছেন 'জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা' (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার)। এই কমিটিতে বিভিন্ন ধরনের সদস্য আছেন। তবে এখনো পর্যন্ত জাতীয় সুরক্ষা নীতির কোনো খসড়া এই কমিটি পেশ করেনি।


'দশদিশা প্যারাডাইম'


আজকের চিন-আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে এক দৃঢ়, স্বচ্ছ ও বলিষ্ঠ জাতীয় সুরক্ষা নীতির প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। এক সামগ্রিক সমন্বিত সুরক্ষা নীতি গ্রহণ ও প্রয়োগ আজ অবশ্যম্ভাবী। বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর জাতীয় সুরক্ষা নীতির রূপরেখা নির্ভর করে, যে ফ্যাক্টরগুলিকে সামগ্রিক ভাবে আমরা বলতে পারি 'দশদিশা প্যারাডাইম'। এবার সেই সব দিশা নিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনা।


আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

প্রথম, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের 'দ্বিকেন্দ্রীক ঠাণ্ডা যুদ্ধের' অবসানের পর ১৯৯১ সালের পর কিছু দিন বিশ্ব রাজনীতি ছিল মূলতঃ এককেন্দ্রিক- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য। কিন্তু ভারতের হাত ধরে 'বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা'য় (ডব্লিউ টি ও) চিনের প্রবেশের পর বিশ্ব বাণিজ্যে চিনের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চিনের উত্থানে একবিংশ শতাব্দীতে একমেরু বিশ্বের অবসান হয়েছে। অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গে চিন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় সামরিক শক্তি, যা বিশ্ব রাজনীতির এক-মেরুত্বকে শুধু বহু-মেরুত্বেই পাল্টে দেয়নি, তার সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতির ভরকেন্দ্রকে এশিয়াতে নিয়ে এসেছে। 

এই বহু-মেরু বিশ্বে ভারত কখনোই ঠান্ডা যুদ্ধের কালের মতো 'নির্জোট আন্দোলনের' শরিক হতে পারবে না; কারণ ওই আন্দোলনের আর কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই। মোদী সরকার অবশ্য এই 'আইডিয়ালিস্টিক ট্র্যাপ' থেকে বেড়িয়ে এসেছে। এখন সময় এসেছে, ভারতকে বহু-মেরুত্বকে স্বীকার করে এশিয়াতে এক 'পোল পজিশন' নিয়ে চিনের বিস্তারকামী নীতির বিরুদ্ধে 'নেতৃত্ব দেওয়া'। 

ঠিক এখানেই প্রশ্ন, এই বহু-মেরু বিশ্বে রাষ্ট্রসংঘের ভূমিকা কি? রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোগত পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কতোটা? নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য সদস্যদের ভূমিকা কি? এটা এখন পরিস্কার যে, বর্তমান বহু-মেরু বিশ্বে রাষ্ট্রসংঘ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যও রাষ্ট্রসংঘের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে খুব বেশি ইচ্ছুক নয়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য করতে তারা শুধু মুখের কথাই বলছে; আর চিন তো একেবারে বিপক্ষে। তাই ভারতের উচিৎ এশিও-ভারত মহাসাগরীয় তথা এশিও-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এবং মধ্য-এশিও অঞ্চলে বিভিন্ন 'পাওয়ার-ক্লাস্টারে' সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া, যাতে রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা যায়। 


পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি

দ্বিতীয়, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি। ভারতের সীমান্ত-সংলগ্ন প্রতিবেশী দেশগুলোর পরে যে বিভিন্ন অঞ্চলগুলো রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল (ইন্ডিয়ান ওশান রিজিয়ন), যার একদিকে এশিও-আফ্রিকান দেশগুলো, অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিও দেশগুলো। তার সঙ্গে আসিয়ান দেশসমূহ। স্থলভাগের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মধ্য-এশিও অঞ্চল (সেন্ট্রাল এশিয়া)। 

জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও মালাক্কা প্রণালীর উপর প্রভাব বজায় রাখা হলো ভারতের অন্যতম দিশা। আন্দামানে ভারতের প্রথম থিয়েটার কমান্ড তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে চিনের ক্রমবর্ধমান নৌশক্তির মোকাবিলা করার জন্য ভারত প্রস্তুত। আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের 'কোয়াড' এখন এক চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে দক্ষিণ-চিন সাগর থেকে শুরু করে পূর্ব-চিন সাগর হয়ে প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চিনের আধিপত্য বিস্তারের ছককে রোখা যায়। 'আসিয়ান' দেশগুলো চিনের বিস্তারকামী আক্রমণের মোকাবিলার জন্য ভারতের নেতৃত্ব আশা করছে। নিজের সুরক্ষার জন্যই ভারতকে সেই সুযোগ নিতে হবে। সেই একই ধরনের নীতি প্রযোজ্য মধ্য-এশিও অঞ্চলের ক্ষেত্রেও। এই অঞ্চলে ভারতকে সক্রিয়ভাবে রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক সহযোগিতায় আবদ্ধ হতে হবে। তবেই আফগানিস্তানে ভারতের স্ট্রাটেজিক স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হবে, যা জাতীয় সুরক্ষার অংশ।

প্রতিবেশী দেশ

তৃতীয়, প্রতিবেশী দেশ। জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলো। চিন-পাকিস্তান অক্ষশক্তিকে মোকাবিলা করাই ভারতের সুরক্ষা নীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভারতের নীতির এক আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। উরি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক আর বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক সেই পরিবর্তিত নীতিরই পরিচায়ক। কিন্তু, চিনের ক্ষেত্রে সেই একই নীতি নেওয়া কঠিন। তবে প্রতিরোধমূলক নীতি গ্রহণ অপরিহার্য; আর বর্তমান ভারত সরকার সেই নীতিই নিয়েছে। 

জাতীয় সুরক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের উন্মুক্ত অঞ্চলগুলোকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব উপযুক্ত ফেন্সিং সিস্টেম দিয়ে সুরক্ষিত করা দরকার। একই সঙ্গে ভারত-মায়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার; কারণ, উত্তর-পূর্ব ভারতে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে পুনরায় সক্রিয় সহযোগিতা করতে চিন সচেষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে চিন বর্তমান নেপাল সরকারকে সীমান্ত এলাকা নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পথে যেতে উসকানি দিয়ে চলেছে। সেক্ষেত্রে সংযম দেখিয়ে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করা ছাড়া ভারতের উপায় নেই। 

তবে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ও গিলগীট-বালটিস্থান যে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা ভারত সরকার ঘোষণা করেছে এবং এই সব অঞ্চল পুনরুদ্ধারের নীতি গ্রহণ জাতীয় সুরক্ষার অংশ হওয়া উচিৎ। সেই সঙ্গে আকসাই চিন অঞ্চলও যে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সুরক্ষা নীতিতে গ্রহণ করা দরকার, যা ভারতের জাতীয় মানচিত্রে প্রতিভাত হবে।

বৈদেশিক নীতি

চতুর্থ, বৈদেশিক নীতি। ভারত রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ঐতিহাসিক ভাবেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বিভিন্নতাকে স্বীকৃতি ও বিশ্বাসযোগ্যতার উপর গড়ে উঠেছে। একবিংশ শতাব্দীতে ভারতের লক্ষ্য এক 'লিডিং গ্লোবাল পাওয়ার' হয়ে উঠে জাতীয় সুরক্ষাকে জোরদার করা। সেই লক্ষ্যে, চিনের মতো 'ডমিনান্ট' নয়, বরং ভারতের লক্ষ্য হবে 'গ্রেট পাওয়ার' হওয়া, যার ভিত্তিই হবে মূল্যবোধ-ভিত্তিক শক্তিশালী পররাষ্ট্র নীতি। এই মূল্যবোধ-ভিত্তিক পররাষ্ট্র নীতির দুই দিক: সফট পাওয়ার ও হার্ড পাওয়ার। 

ভারতের সাংস্কৃতিক তথা সভ্যতার পরম্পরাগত ঐতিহ্য হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে আধার করে একদিকে তিব্বত, চিন, জাপান; অন্যদিকে সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই ভারতের 'সফট পাওয়ারের' ভিত্তিই হচ্ছে ভারতীয় ধার্মিক ঐতিহ্য ও পরম্পরা, যা 'বসুধৈব কুটুম্বকম'- 'পৃথিবীর মানবজাতি একই পরিবারভুক্ত'- নীতিতে বিশ্বাসী। যদিও এই নীতির স্বরূপ মূলতঃ আধ্যাত্মিক, তবুও রাষ্ট্রগতভাবে এই নীতি ততদূরই প্রযোজ্য যতোদূর অন্য রাষ্ট্র এই নীতিকে মান্যতা দেবে। এখানেই 'হার্ড পাওয়ারের' প্রাসঙ্গিকতা, যার ভিত্তিই হচ্ছে 'অহিংসা পরমধর্ম, ধর্ম হিংসা তদৈব চ'; রাষ্ট্রগতভাবে পররাষ্ট্রের হিংসাত্মক আগ্রাসন ও আক্রমণ ঠেকানোর জন্য সবসময় প্রস্তুত থেকে 'হিংসাকে হিংসা দিয়েই প্রতিহত' করার মানসিক তথা বস্তুগতভাবে ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। 

এই প্রেক্ষাপটেই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যে বিভিন্ন 'কনফ্লিক্ট জোন' তৈরি হয়েছে, তার সাপেক্ষে ভারতকে বিভিন্ন 'রিজিওনাল সিকিউরিটি এলায়ান্স' তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা নিতেই হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এখন 'পুবে তাকাও'- 'লুক ইস্ট' পলিসি এখন 'অ্যাক্ট ইস্ট' পলিসিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান মোদী সরকারের উচিত হবে পরবর্তী ধাপে অর্থাৎ 'নেটওয়ার্ক ইস্ট' (Network East) পলিসিতে পৌঁছনো, যাতে করে চিন বাদে 'আসিয়ান' প্লাস ফাইভ দেশগুলোকে নিয়ে একটা সুরক্ষা বলয় তৈরি করা। এই সুরক্ষা বলয়কে ঘিরে থাকবে আন্তর্জাতিক স্তরের 'কোয়াড' (Quad) চতুঃশক্তি- 'কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ'। 

একই সঙ্গে চিনের ব্যাপারে 'এক চিন' নীতি থেকে 'দুই চিন' নীতি নিয়ে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ নিয়ে ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে চিনের নাক গলানোর ব্যাপারে উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। আর, শুধু দুই চিন অর্থাৎ মূল ভূখণ্ডের চিন ও তাইওয়ান চিনই নয়, বরং 'বহু চিন' অর্থাৎ তিব্বত, ইনার মঙ্গোলিয়া, জিংজিয়ান প্রদেশগুলোর ব্যাপারেও ভারতের ভাবার সময় এসেছে। একই ভাবে পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের স্বাধীনতাকামী বালুচদের ব্যাপারেও বিদেশনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন করতে হবে। 'সিপেক'কে আটকাতে হলে ভারতের 'শঠে শাঠ্যাং সমাচরেৎ' নীতি গ্রহণ করতেই হবে।

কূটনৈতিক কৌশল

পঞ্চম, কূটনৈতিক কৌশল। কূটনীতির ক্ষেত্রে ভারতের সভ্যতাগত ঐতিহ্য, যার ভিত্তিস্বরূপ হচ্ছে চাণক্যের 'অর্থশাস্ত্র', তার প্রয়োগ কিন্তু রাষ্ট্র হিসাবে ভারত করতে যেন ইতস্তত বোধ করে। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে কূটনৈতিক কৌশল হিসাবে দুইটি প্রধান কৌশলের কথা অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে: একটি 'রাজমন্ডল', আরেকটি 'সাম-দান-ভেদ-দন্ড' কৌশলনীতি। রাজমন্ডল কৌশলের সাপেক্ষে রাষ্ট্রের চারদিকে যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি থাকবে, তাদের সাপেক্ষে সবসময় 'নরম-গরম', ইংরেজিতে যাকে বলে 'ব্লো হট, ব্লো কোল্ড', কৌশল নিয়ে চলতে হবে। আর, সেই অনুযায়ী সাম-দান-ভেদ-দন্ড নীতির প্রয়োগ ঘটাতে হবে। 

কূটনীতি সবসময়ই প্রায় 'ট্রানজাকশনাল' ধরনের। এখানে দেনা-পাওনার নীতিই প্রধান। রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে নিজের সুরক্ষার জন্য এই 'ট্রানজাকশনাল ডিপ্লোমাসি' গ্রহণ করা অতি আবশ্যক। তার সঙ্গে 'এপিক ডিপ্লোমাসি' অর্থাৎ মহাকাব্যিক কূটনৈতিক নীতিকৌশলের প্রয়োগ। রামায়ণ ও মহাভারত - এই দুই মহাকাব্যের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক ভাবেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তারই সংস্কৃতিগত, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্কের আধুনিকীকরণ করতে হবে। 

সামরিক শক্তি

ষষ্ঠ, সামরিক শক্তি। বিশ্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি। কিন্তু থিয়েটার বা ভৌগোলিক অঞ্চলের সাপেক্ষে মাত্র দুটি 'থিয়েটার কমান্ড' তৈরি করা গেছে; এখনো বাকি আছে সতেরোটি একক-কমান্ড (আর্মি-৭, বায়ুসেনা-৭ ও নৌসেনা-৩), যেসব কমান্ডগুলিকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব একীকৃত বা ইউনিফায়েড করা দরকার। আশার কথা, আগামী দু'বছরের মধ্যে পাঁচটি থিয়েটার কমান্ড তৈরি হচ্ছে।

আজকের বিশ্বে প্রথাগত যুদ্ধের থেকেও অপ্রথাগত যুদ্ধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই অপ্রথাগত যুদ্ধের ক্ষেত্রে 'সাইবার যুদ্ধের' ভূমিকা অনস্বীকার্য। এরসঙ্গেই আগামীতে যুক্ত হবে 'স্পেস ওয়ার'। ভারত সরকারকে অনতিবিলম্বে এক 'জাতীয় স্পেস পলিসি' তৈরি করতে হবে, যার মধ্যে সাইবার ও স্পেস যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত নীতিমালার সংস্থান থাকবে। 

সামরিক শক্তি শুধুমাত্র অস্ত্রশস্ত্রের উপর নির্ভর করে না, ইতিবাচক মানসিকতাও আরেক দিক; যা ভারতীয় সামরিক বাহিনী বারবার প্রমাণ দিয়েছে। ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও জাতীয় সুরক্ষার জন্য সামরিক বাহিনীকে সরাসরি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে এক 'জাতীয় সামরিক নীতি' (ন্যাশনাল মিলিটারি পলিসি) তৈরি করার দিকে এগুতে হবে।

আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি

সপ্তম, আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি‌। প্রথমেই বোঝা দরকার, রাষ্ট্র হিসেবে ভারত একটি একীভূত সত্তা, একটি ইউনিয়ন; ইউনাইটেড বা সংযুক্ত সত্তা নয়। বিভিন্ন রাজ্যের চুক্তির মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয় নি; রাজ্যগুলির কোনো আদিসত্তা বা কনস্টিটুয়েন্ট চরিত্র নেই। রাষ্ট্রের সাপেক্ষেই রাজ্যগুলোর অস্তিত্ব। তাই জাতীয় সুরক্ষা নীতির পরিপ্রেক্ষিত সবসময়ই হবে রাষ্ট্র, রাজ্যগুলি নয়। 

সংবিধান অনুযায়ী আইন ও শৃঙ্খলা রাজ্য তালিকাভুক্ত, রাজ্যের বিষয়। কিন্তু, জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে এ ব্যাপারকে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে কিছু রিফর্ম দরকার। আইন ও শৃঙ্খলাকে আলাদা করে আইন পুলিশ ও শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী পুলিশ- এই দুইটি ইনস্টিটিউশনাল ভার্টিকেল গড়ে তোলা দরকার, যাতে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা-জনিত কেসগুলিকে উপযুক্ত দক্ষতায় বিচার করা যায়। সার্বিক পুলিশ রিফর্ম আর ফেলে রাখা উচিৎ নয়। এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশও আছে। 

কোভিড অতিমারী মোকাবিলার ক্ষেত্রে 'ডিসেস্টার ম্যানেজমেন্ট' আইন সারা ভারত-ব্যাপী যে কেন্দ্রায়িত বিকেন্দ্রীকরণের টেমপ্লেটের রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছে, তার উপর ভিত্তি করেই আভ্যন্তরীন সুরক্ষা নীতির রূপরেখা তৈরি করা যেতে পারে।  

একদিকে অতি-বাম মাওবাদী হিংসা, আরেক দিকে আব্রহামীয় ধর্মমত-ভিত্তিক ধর্মান্তরকরণ ও বিশ্বায়িত সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ - এই ত্রিফলা রাষ্ট্র-বিরোধী কার্যক্রম মোকাবিলা করতে 'যা আভ্যন্তরীণ, তাই বাহ্যিক; যা বাহ্যিক, তাই আভ্যন্তরীণ' (Inside is Out; Outside is In) - এই নীতিকে গ্রহণ করে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি-ভিত্তিক জাতীয় সুরক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যা বর্তমান ভারত সরকার বিভিন্ন ভাবেই করে চলেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিদেশী দান আইন সংশোধন।

অর্থনৈতিক শক্তি

অষ্টম, অর্থনৈতিক শক্তি। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে জিডিপিতে বিশ্বে ভারত তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি, আর নমিনাল জিডিপির সাপেক্ষে পঞ্চম শক্তি। ভারতের বাজারের শক্তি এখন এক প্রতিষ্ঠিত বাস্তব। সম্প্রতি জিএসটি সংগ্রহের সাপেক্ষে কোভিড পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার লক্ষণ পরিস্ফুট। এই পরিস্থিতিতেও কৃষিতে বৃদ্ধির হার বেড়েছে। শিল্পোৎপাদনের হারও আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু, লকডাউনের প্রভাব সবথেকে বেশি পড়েছে সার্ভিস সেক্টরে। মেগাসিটিগুলো ও বড় নগরগুলো যতো তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে, ততই সার্ভিস সেক্টরের বিভিন্ন পরিষেবা ক্ষেত্রগুলি কর্মসংস্থান তথা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে 'গ্রোথ ইঞ্জিন' হিসাবে কাজ করতে পারবে। 

জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শক্তি এক অপরিহার্য শর্ত (Necessary condition); যদিও তা পর্যাপ্ত শর্ত (Sufficient condition) নয়। পাক-চিন সীমান্ত-পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র-সুরক্ষার জন্য ভারতকে বাধ্য হয়ে যে অর্থনৈতিক সম্পদ ব্যয় করতে হচ্ছে, তার জন্য ভারতকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হতেই হবে। 

সেই লক্ষ্যেই ভারত সরকার কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে যে সব সংস্কারমূলক আইন তৈরি করেছে তার ইতিবাচক প্রভাব ধীরে ধীরে পড়বে। 'আত্মনির্ভর ভারতের' প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, অর্থনৈতিক ভাবে যতোটা সম্ভব স্বনির্ভর হয়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে হাত-মেলানো, যাতে বাইরের পৃথিবীতে নিজের অর্থ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা যায়। তাই রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার স্বার্থে আঞ্চলিক তথা মহাদেশীয় স্তরে বিভিন্ন বাণিজ্য-গোষ্ঠী তৈরি করা ভারতের অন্যতম অর্থনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিৎ।

সরকারি নীতিগত অবস্থান

নবম, সরকারি নীতিগত অবস্থান। জাতীয় স্বার্থরক্ষাই হচ্ছে জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি নীতির একমাত্র আধার। জাতীয় সচেতনতার উপর ভিত্তি করেই সেই স্বার্থরক্ষার্থে সরকারি নীতি-নির্ধারণ করা দরকার। এক্ষেত্রে সরকারি নীতিগত অবস্থান হওয়া উচিৎ একীভূত কেন্দ্রায়িত বিকেন্দ্রীকরণ (Unified centralised decentralisation) ভারত সরকার সেই নীতিগত অবস্থান নিয়েই বিভিন্ন আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার নীতি রূপায়ণ করে চলেছে। কারণ, জাতীয় স্বার্থ তথা জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের মতাদর্শগত (ইডিওলজিকাল) অবস্থান নয়, বরং বাস্তবোচিত (প্রাগম্যাটিক) নীতিগ্রহণই ভারত সরকারের নীতিগত অবস্থান হওয়া উচিৎ। 


সরকারি কৌশলগত নীতি

দশম, সরকারি কৌশলগত নীতি। বাস্তবোচিত নীতি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কৌশলগত বা স্ট্রাটেজিক পলিসি নেওয়া জাতীয় সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। 

ম্যানেজমেন্ট তাত্ত্বিক হেনরি মিনজবার্গের (১৯৮৭) 'পাঁচ কৌশল' ( 5 P's of Strategy- Plan, Pattern, Position, Perspective and Ploy) অনুসরণ করে বলা যায়, রাষ্ট্রগত ভাবে জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে ভারত সরকারকে উপযুক্ত কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হবে। 

সেই কৌশলের অঙ্গ হিসাবে যতো বেশি সম্ভব বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক, আর্থিক তথা প্রতিরক্ষা-ভিত্তিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করা দরকার।

সামনের পথ

জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা জাতি তথা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অপরিহার্য শর্ত। শরীরের মতো ভূ-সীমানাগত অখন্ডতা রক্ষা করা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। 

দশদিশা প্যারাডাইমের উপর ভিত্তি করে জাতীয় সুরক্ষা নীতি প্রণয়ন করে বিস্তারবাদী চৈনিক আগ্রাসন ও সন্ত্রাসবাদী পাকিস্তানি ছায়াযুদ্ধকে উপযুক্ত জবাব দিতেই হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলী সম্পর্ক গড়ে তুলে ভারতকে সার্বিকভাবে সুরক্ষিত করতে হবে।

@ সুজিৎ রায়

04.12.2020

No comments:

Post a Comment