ভারতের সাধারণ মানুষ ও নরেন্দ্র মোদী

'ভারতের সাধারণ মানুষ ও নরেন্দ্র মোদী' নিবন্ধটি প্রখ্যাত সাপ্তাহিক 'স্বস্তিকা' পত্রিকার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।


ভারতের কোন প্রধানমন্ত্রী 'স্বাধীন ভারতে' জন্মগ্রহণ করেছেন? উত্তর একটাই: শ্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। 'সাধারণতান্ত্রিক' ভারতের যাত্রা শুরুর বছরই ১৯৫০ সালে গুজরাটের ভাদনগর থেকে যার এক 'সাধারণ' জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ ৭০ বছরে তিনি এক 'ফেনোমেনন'- এক সাধারণের 'অসাধারণ' হয়ে ওঠার মূর্ত প্রতীক! তিনি আজ সাধারণ মানুষের কাছে সনাতন ভারতের ঐতিহ্যবাহী এক 'রাজর্ষী'!

গতবছর ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মোদীজীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারের লড়াই ছিল ক্ষমতা ধরে-রাখার লড়াই। এখানেই প্রশ্ন, 'সাধারণ ভোটার' কি ভেবে, কি অংক কষে, কি লাভ-ক্ষতির হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে পুনরায় বিপুল ভোটে ফিরিয়ে নিয়ে এলো? আরো গভীর প্রশ্ন, সাধারণ ভারতীয়রা নরেন্দ্র মোদীকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেন?

প্রথমেই বলা দরকার, সাধারণ মানুষ কিন্তু কোনো একশিলীভূত মনোলিথিক ধারণা নয়। এক সাধারণ মানুষের মধ্যেই অনেক ধরনের খন্ড-পরিচয়সত্তা অন্তর্লীন হয়ে আছে। এইসব নিয়েই প্রতিটি সাধারণ মানুষ অনেক ধরণের খন্ড-পরিচয়সত্তার এক মিশ্রিত অখন্ড সত্তাবিশেষ। সেখানেই প্রশ্ন, এক সাধারণ ভারতীয় পছন্দ করার সময় বিভিন্ন খন্ড-পরিচয়সত্তার সাপেক্ষে 'ব্যক্তি' নরেন্দ্র মোদীকে  কিভাবে বিচার করেন?

এখানেই একটা প্রশ্ন ওঠে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় মানুষ কি সমস্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি, সব কারণ, ফ্যাক্টরগুলোকে বিচার বিশ্লেষণ করতে পারে বা সুযোগ পায়? আবার, নেতা বা প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় নেতার নেতৃত্বক্ষমতাকে কিভাবে দেখেন? 

সমাজতত্ত্ব শাস্ত্রের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ম্যাক্স ওয়েবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের সফলতার ক্ষেত্রে তিন ধরনের ভিত্তির (Ideal types of political leadership) কথা বলেছিলেন: আকর্ষণীয়/ক্যারিশমা-ভিত্তিক নেতৃত্ব, ঐতিহ্য/ট্রাডিশন-ভিত্তিক নেতৃত্ব ও আইন-ভিত্তিক নেতৃত্ব। কিন্তু, ঘটনা হলো, নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে কোনো একটি ভিত্তি নয়, বরং তিনটি ভিত্তিই সমানভাবে প্রযোজ্য। তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, তার সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্য-সংপৃক্ততা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ-ভিত্তিক আইনি ক্ষমতা-প্রয়োগের সামর্থ্য- এই তিনের অদ্ভুত মিশেল সাধারণ ভারতীয়দের কাছে নরেন্দ্র মোদীকে করে তুলেছে এক অনন্য-সাধারণ জাতীয় নেতা। তারই প্রতিফলন ঘটেছে গতবছরের জাতীয় নির্বাচনে।

কিন্তু এখন প্রশ্ন, একজন সাধারণ ভোটার  কি শুধু আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণেই সেই ব্যক্তির দলকে ভোট দেয়? এখানেই নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রবিদ তথা মনস্তত্ত্ববিদ হারবার্ট সিমোনের তত্ত্ব প্রাসঙ্গিক। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ‘সীমাবদ্ধ যৌক্তিকতা তত্ত্ব' – Bounded Rationality Theory এবং ‘সন্তোষকারক তত্ত্ব' – Satisfysing Theory অবতারণা করেছিলেন। অর্থাৎ মানুষ কোনো ক্ষেত্রেই কোনো সময়েই কোনো বিষয়েই সব ধরনের কারন/ফ্যাক্টর জানতে পারে না। তাই পুরোপুরি যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হতে পারে না। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই 'সন্তোষকারক সিদ্ধান্ত' নেয়। 

আবার, আরেক বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ আব্রাহাম মাসলোর ‘প্রয়োজনের হায়ারার্কি তত্ত্ব' -  Need Hierarchy Theory সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভোটারের মানসিকতা বুঝতে সাহায্য করে। এই তত্ত্বানুযায়ী, মানুষের বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনের পিরামিড-ভিত্তিক কাঠামোর বেস/সর্বনিম্ন স্তরে আছে মানুষের জৈব চাহিদা পূরণের প্রয়োজন। তারপর ধাপে ধাপে অন্যান্য প্রয়োজন-পূরণের চাহিদা – সুরক্ষার চাহিদা, সামাজিক সম্পর্ক-স্থাপনের চাহিদা, সম্মানলাভের চাহিদা, আর শেষে আত্ম-তুষ্টিকরণ বা 'সেল্ফ-অ্যাকচুয়ালাইজেশন' যেখানে মানুষের বাইরের কোনো চাহিদা পূরণের আকাঙ্ক্ষা নেই। 

এর সঙ্গেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পুশ ও পুল ফ্যাক্টর কাজ করে। পুশ ফ্যাক্টর হলো সেই সব ফ্যাক্টর যেগুলো একজন মানুষকে আগের পছন্দগুলো থেকে সরিয়ে দেয়। আর, পুল ফ্যাক্টর মানুষকে নতুন পছন্দগুলোর দিকে নিয়ে যায়।

এই চার ধরনের প্যারাডাইম তথা প্রেক্ষাপটে – নেতৃত্ব-ক্ষমতা, সীমাবদ্ধ যৌক্তিকতা ও সন্তোষকারকতা, বিভিন্ন স্তরের চাহিদা পূরণ এবং পুশ-পুল ফ্যাক্টর – এইসব নিয়েই একটা ‘পারসেপশন’ গড়ে ওঠে যা মোটামুটি একজন সাধারণ মানুষকে ভোটের সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে। সাধারণ ভারতীয়রা নরেন্দ্র মোদীজির মধ্যে তাদের সমস্ত ধরনের প্যারাডাইমের মেলবন্ধনকে খুঁজে পেয়েছে। এবার সেই আলোচনা। 

জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয়তাবোধ, ভারতীয় জাতিসত্তা – এসবের ক্ষেত্রে মোদীজির সদর্থক ভূমিকা পুল-ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করছে। উরি, বালাকোট থেকে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তাই এখন ভারত-চিন সীমান্ত-সংঘর্ষে প্রতিফলিত হচ্ছে। চিনের 'সালামি স্লাইসিং' পলিসি ভারতীয় প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। জাতীয়-স্বার্থে মোদীজির অথরাইটেটিভ নেতৃত্বদানের ক্ষমতাতে সাধারণ ভারতীয়দের পূর্ণ আস্থা আছে। 

সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাপূরণের ক্ষেত্রে মোদীজির উদ্যোগ কেমন? ২০১৪ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে মোদীজি সাধারণ মানুষকে এক অবাক-করা আর্থিক প্রকল্প উপহার দিয়েছিলেন – জনধন যোজনা, সঙ্গে বীমা প্রকল্প। সাধারণ মানুষ সার্বিকভাবে এই প্রথম ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হলো। তারপর, বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প চালু হল, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত- খাদ্য, শৌচালয়, বাড়ি, বিদ্যুৎ, জল, রাস্তা, গ্যাস, স্বনিযুক্তি কর্মপ্রকল্পের জন্য ঋণ ব্যবস্থা ইত্যাদি। এর সঙ্গে আধার প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি সাহায্য সরাসরি অ্যাকাউন্টে ঢোকা; তার সঙ্গে কৃষককে সরাসরি অর্থসাহায্য, কৃষক-শ্রমিকদের জন্য পেনশন প্রকল্প। এছাড়া বর্তমানে চালু আয়ুস্মান ভারত প্রকল্প সাধারণ ভারতীয়দের স্বাস্থ্য-বিমায় এক দিক-নির্দেশক প্রকল্প। এছাড়া, সামাজিক মাধ্যমকে মোদীজি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক-স্থাপনের ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন। এ সবই পুল ফ্যাক্টর।

নোটবন্দী ও জিএসটি- দুই ক্ষেত্রেই নরেন্দ্র মোদীজি সরাসরি দায়িত্ব নিয়েছেন। তার সদর্থক দুর্নীতিমুক্ত সরকার চালানোর ইচ্ছা তথা ক্ষমতা ও রাজর্ষিসুলভ ব্যক্তিগত জীবনযাপন- সাধারণ ভারতীয়দের কাছে এক আদর্শ। আজকের সমাজে সেল্ফ-অ্যাকচুয়ালাইজেশনের প্রতিমূর্তি হলেন শ্রীনরেন্দ্র মোদী, যিনি সনাতন ভারতের স্বরূপবিশেষ রূপে সাধারণ ভারতীয়দের কাছে প্রতীয়মান হয়েছেন।

এবারে পুশ-ফ্যাক্টরের ভূমিকা। যখনই পছন্দের কথা আসে, তখনই সাধারণের মনে আসে প্রথম প্রশ্ন, বিকল্প কে? সত্যিই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এক সাধারণ ভারতীয় এমন কোনো বিকল্প নেতা পায়নি, যার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা মোদীজির থেকে বেশি। এর সঙ্গে অন্য পুশ ফ্যাক্টর হলো, ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করা ও তাকে অনবরত ব্যক্তি-আক্রমণ করা, যা সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। 

সব মিলিয়ে, একবিংশ শতাব্দীতে সাধারণ ভারতীয়দের কাছে নরেন্দ্র মোদী শুধু মাত্র একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন; তিনি এক প্রতিষ্ঠান, যিনি 'নতুন ভারত'-রূপকার, যার নেতৃত্বে ভারতের আর্থ-সামাজিক তথা ভূ-রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটছে।





@ সুজিৎ রায়

No comments:

Post a Comment

Emerging Horizons For Women Entrepreneurship: A Sociological Enquiry

Ebook of my PhD Thesis "Emerging Horizons For Women Entrepreneurship: A Sociological Enquiry" is now in public domain after ten ye...