লকডাউন, জীবন ও জীবিকা: পথের খোঁজে ভারত


লকডাউন- ভারতবাসীর জীবনে এক নতুন শব্দ, যা ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবনে এক অভূতপূর্ব অধ্যায়ের সূচনা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় লকডাউন এখন চলছে এই ভারতে। সারা বিশ্ব অবাক চোখে দেখছে এই লকডাউনকে, যা সত্যিই বিস্ময়কর! কেউ কেউ ভেবেছিল, এই লকডাউনের বিরুদ্ধে সাধারণ ভারতবাসী ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়বে, সিভিল আনরেস্ট তৈরী হবে! তারা আরো একবার ভুল প্রমাণিত হলো। 

চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এখন সারা পৃথিবীতে যেভাবে মৃত্যু-মিছিলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সমগ্র মনুষ্য-জাতি তথা সভ্যতাকে এক অস্তিত্ববাচক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের বিশ্ববীক্ষা, আমাদের জীবন-চর্চা, আমাদের মূল্যবোধের মাপকাঠি - সবকিছু যেন এক লহমায় ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে! ঠিক এই সন্ধিক্ষণে, আমরা ভারতবাসী কিভাবে এই পরিবর্তনকে দেখব, কিভাবে নিজেদেরকে পাল্টে নেব - রাষ্ট্রগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনচর্চায়?

লকডাউনের তৃতীয় সপ্তাহে এসে সকলের মনেই এই প্রশ্ন: লকডাউনের মেয়াদ কি বাড়বে, না কি ২১ দিনেই তা শেষ হবে? লকডাউন একবারে তুলে নেওয়া হবে, না কি সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় ধাপে ধাপে লকডাউন তোলা হবে? জীবন, না কি জীবিকা - কোনটা 'প্রায়োরিটি' পাবে? হাজারো প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে সরকার, স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতির নীতিনির্ধারক তথা আপামর জনসাধারণ। তবে, বিভিন্ন রাজ্য লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল করেছে। আবার, কোনো কোনো রাজ্য করোনা-আক্রান্ত এলাকা- হটস্পটগুলিকে আলাদা করে চিহ্নিত করে স্থানীয় স্তরে লকডাউন চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে। এখানেই যে কেন্দ্রীয় আইন অর্থাৎ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট (ডি এম) অ্যাক্ট, ২০০৫ যার মাধ্যমে ভারত সরকার জাতীয় স্তরে এই লকডাউন করেছে তার প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে কিছু রাজ্য লকডাউনের মেয়াদ রাজ্যস্তরে বাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা করে দিয়েছে, যেমন, ওড়িশা আর পাঞ্জাব সরকার।

প্রধানমন্ত্রী মোদি এই করোনা-বিপর্যয়কে 'সোশ্যাল ইমার্জেন্সি' অর্থাৎ সামাজিক জরুরীকালীন অবস্থা বলেছেন। এই অবস্থাকে মোকাবিলা করার জন্যই তিনি সব ভারতবাসীকে সামাজিক তথা মানসিক ভাবে সচেতন ও একতাবদ্ধ করার পথে বিভিন্ন সামাজিক পদক্ষেপ নিয়েছেন, যথা, 'জনতা কারফিউ', 'একতাই শক্তি' ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে মানুষ এগুলোকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসাবে ধরেই সাড়া দিয়েছে। ঠিক এখানেই করোনাজনিত উদ্ভুত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে জাতীয়, রাজ্য তথা স্থানীয় স্তরে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কিছু আলোচনা করা যায়। 

করোনা-ক্রাইসিস নতুন করে আমাদের মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা - এই পাঁচটি চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতা মনে করিয়ে দিল। লকডাউনে যখন সবাই গৃহবন্দী, তখন ভারতব্যাপী প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংগ্রহ ও বন্টন সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। সাপ্লাই এ্যান্ড ডিসট্রিবিউশন চেইন ম্যানেজমেন্ট এই লকডাউনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের প্রতিটি প্রান্তে প্রতিটি ঘরে প্রতিটি মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছনোর জন্য যে ধরনের সমন্বয়-ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, তা কি ভারতে গড়ে উঠেছে? বর্তমান যে ডি এম অ্যাক্ট, ২০০৫ অনুযায়ী লকডাউন চালু করা হয়েছে, তা এক্ষেত্রে কতোটা কার্যকরী? এই লকডাউন থেকে নিশ্চিতরূপেই আমরা ভবিষ্যতের এক রূপরেখা পাব।

এই লকডাউনের প্রথম পর্বেই আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা দেখেছি। ভারতে অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে সবথেকে সমস্যায় আছে এই লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিক। বিভিন্ন রাজ্য তাদের খাদ্য-বাসস্থানের সাময়িক ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু, যত তাড়াতাড়ি তাদেরকে নিজ নিজ রাজ্যে নিজেদের পরিবারে পাঠানো যাবে, ততই সেই সব শ্রমিকদের শারীরিক তথা মানসিক স্বাস্থ্য বজায় থাকবে। হয়তো ভারত সরকার বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করতে পারে। তবে, ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আধার কার্ড-ভিত্তিক 'এক দেশ, এক রেশন কার্ড' ব্যবস্থা চালু করা দরকার। সেক্ষেত্রে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতেই হবে। এরসঙ্গেই ভবঘুরে, ভিক্ষাজীবী, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কিভাবে সুরাহা দেওয়া যায় তা সব সরকারকেই ভেবে দেখে ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরী করতে হবে।

করোনাভাইরাস আমাদের আবার এক মৌলিক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। ধর্ম, ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মতন্ত্র যে এক নয়, তা আমাদের বুঝতে হবে। সেখানেই রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা আছে। তবলিগি জামাত শিবিরের ঘটনা জন সুরক্ষা (পাবলিক সেফটি) বনাম ধর্মীয় বিশ্বাসের ইস্যু নিয়ে রাষ্ট্রের সদর্থক ও সক্রিয় ভূমিকা দাবি করে। একই সঙ্গে নাগরিকদের গোষ্টীবদ্ধ ধর্মীয় আচার পালনের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যগত ও আইনশৃঙ্খলা-জনিত সমস্যাকে বুঝে নিজেদের জীবনচর্চায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে হবে। 

ভারত সরকার ১.৭০ লক্ষ কোটি টাকার যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে দিয়ে করোনাজনিত অর্থনৈতিক সমস্যাকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। মানুষের হাতে ক্যাশ টাকা নিশ্চয় দিতে হবে; তবেই ডিমান্ড বাড়বে। কারণ, প্রচুর মানুষ, বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে, কাজ হারাবে। ভবিষ্যতে ভারত সরকার হয়তো আরো ডিরেক্ট ক্যাশ বেনিফিটের ব্যবস্থা করবে। 

ভারতে আজকের পরিস্থিতিতে আমরা কখনোই জীবন বনাম জীবিকা - এই ইস্যুতে যাব না; কিভাবে জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করা যায়, সেটাই আমাদের বিচার্য। একদিকে করোনা-টেস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে যেতে হবে, হটস্পটগুলিকে চিহ্নিত করে লকডাউনে রাখতে হবে, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারান্টাইনে রাখতে হবে, আক্রান্তদের উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসা-কর্মীদের সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে, দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে; অন্যদিকে ধাপে ধাপে সার্বিক লকডাউন তুলে নিয়ে এলাকা-ভিত্তিক লকডাউনের ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে হবে। 

এখন ফসল তোলার সিজন। ভারতের আর্থ-সামাজিক জীবনে কৃষির যে প্রধান ভূমিকা, তা আবার বোঝা যাচ্ছে। গ্রাম-শহর-নগরকে আলাদা করে না দেখে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনধারার দৃষ্টিভঙ্গিতে এক নতুন ভারত গড়ে তোলার সুযোগ এসেছে। তার জন্য অনেক ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ভারতীয়দের যেমন অনেক ব্যক্তিগত তথা গোষ্টীগত আচার আচরণের পরিবর্তন করতে হবে, তেমনি দেশের সার্বিক উন্নয়নে রাজনৈতিক নেতৃবর্গকেও সমন্বয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীক জীবনেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। আবহমান ধার্মিক ভারতের সামনে এ এক যুগসন্ধিক্ষণ!

@ সুজিৎ রায়
21.03.2020

No comments:

Post a Comment