বিশিষ্ট পত্রিকা 'বিশ্ব হিন্দু বার্তা', মার্চ ২০২০ মাসিক সংখ্যায় আমার নীচের নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে।
বিদেশী দান: এক গোপন এজেন্ডা?
ভারতে বিদেশী দান (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১০ অর্থাৎ এফ সি আর এ, ২০১০ নামে এক সার্বিক আইন আছে, যার মাধ্যমে ভারত সরকার কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব ধরনের বিদেশী দান বিভিন্ন সংস্থা কিভাবে গ্রহণ করবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক সংস্থা, রাজনৈতিক দল ছাড়া আর যে সব সংস্থা এই বিদেশী দানের দ্বারা পুষ্ট হয় তাদের মধ্যে অসরকারি সংস্থা (এনজিও) গুলো সবথেকে বেশি উল্লেখযোগ্য। প্রশ্ন হলো, এই অসরকারি/স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে বিদেশী দানের ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারত সরকার কতোটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে?
নামের দ্বারাই বোঝা যায় যে, অসরকারি সংস্থাগুলো সরকার-সাপেক্ষ নয় এবং এগুলো সাধারণ ভাবে স্বেচ্ছামূলক ও অব্যবসায়িক ধরনের। 'পাবলিক' সরকারি সংস্থার বিপরীতে এই এনজিও গুলো 'প্রাইভেট' বা সরকারি-নিয়ন্ত্রণহীন। এখানেই কিছু প্রশ্ন ওঠে: এইসব বিদেশী-দানপুষ্ট অসরকারি সংস্থাগুলোকে কতোদূর প্রাইভেট বা সরকারি নিয়ন্ত্রণহীন হিসাবে রাখা যেতে পারে? একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র কতোক্ষণ এইসব অসরকারি সংস্থাগুলোকে 'নিরীক্ষণের' বাইরে রাখবে? কতোক্ষণ এইসব সংস্থার কার্যকলাপকে 'প্রশ্নহীন' ভাবে মেনে নেওয়া হবে?
বিগত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিভিন্ন মানবিক ইস্যুর জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে সংঘটিত সংস্থা হিসাবে অসরকারি সংস্থাগুলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল। পশ্চিমে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে ওঠার সঙ্গে এইধরনের সংস্থার গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং ঔপনিবেশিকতার প্রাচ্য-যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে এই সংস্থাগুলোও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে; বিশেষতঃ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রসংঘ গড়ে ওঠার পরে। গত শতকে 'ঠান্ডা-যুদ্ধের' অবসানের পর এই এনজিওগুলো আরো বেশি গতি পায় ও তৃতীয় বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এটা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া দরকার, অসরকারি সংস্থা মাত্রেই তার একটি 'সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি' আছে, তার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধ আছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি তথা ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশনের ২০০২ সালের নীতিমালা বা কোড অব এথিক্সের সাপেক্ষে ভারতে কার্যরত বিদেশী দান-পুষ্ট বিভিন্ন অসরকারি সংস্থার কার্যক্রম ও তাদের পরিচালনা, আর্থিক-ব্যবস্থাপনা, ব্যয়ের ক্ষেত্র, নিরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ, কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্বের (সিএসআর) সঙ্গে সংযুক্তি ইত্যাদি পর্যালোচনা করা দরকার।
ভারত সরকারের গৃহ-মন্ত্রণালয় এই সব এনজিওদের বিদেশি দান-গ্রহণের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং সেই মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে এইসব এনজিওদের ব্যাপারে যে সব তথ্য আমরা পাই, তা সত্যিই অবাক করার মতো।
তার পরিপ্রেক্ষিতে এইসব এনজিওদের গোপন উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপের পদ্ধতি নিয়ে আমাদের মনে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এসে পড়ে: এই বিদেশি-দান কি এক নয়া-সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার, যা 'দানের ভেক' ধরে মানবহিতের নামে ভারতের সমাজ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে চেষ্টা করছে? এখানেই ইসা জি শিবজীর সমালোচনাকে যথার্থ বলে মনে হয়: "...এই ধরনের এনজিওর সংখ্যার হঠাৎ করেই এতো বৃদ্ধি হচ্ছে পরোপকারের মহৎ উদ্দেশ্যের পরিবর্তে নয়া-উদারবাদের এক অংশমাত্র" এবং "...এনজিওগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী সম্পর্ক বয়ে চলেছে।"
তাই, কিছু প্রাসঙ্গিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ভারত সরকারের গৃহমন্ত্রকের বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকেই আমরা জানতে পারছি যে, গত দু'দশকে এনজিওগুলোতে বিদেশি দান হিসাবে দু'লক্ষ কোটি টাকার বেশি জমা পড়েছে। কিন্তু, তার মধ্যে প্রায় ষোলো হাজার কোটি টাকা অব্যয়িত হয়ে পড়ে রয়েছে, যার মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি অব্যয়িত টাকা প্রায় দু'শতাংশ এনজিওর হাতে পড়ে রয়েছে। কেন? তারপরও বিদেশি দাতারা এইসব এনজিওদের দান পাঠাচ্ছে। কেন? বিদেশি দাতারা এইসব এনজিওর প্রতি এতো 'উদার'! কিন্তু, তারা তাদের নিজেদের দেশবাসীর প্রতি এতো 'দয়াশীল' নয়! কেন? একই ভাবে, আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিকরা এইসব 'সিভিল সোসাইটি' এনজিওদের প্রতি উদার নয় কেন? অথচ, বিদেশি দাতারা এদের প্রতি এতো উদার কেন?
দ্বাদশ শতাব্দী থেকে যদি আমরা ভারতের ইতিহাস দেখি, তাহলে আমরা এই ধরনের বিদেশি দানের 'প্রকৃত' উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছু আন্দাজ করতে পারব। 'মধ্যযুগীয়' মধ্য-প্রাচ্যের ইসলামিক আক্রমণকারীদের থেকে অষ্টাদশ শতকের 'আধুনিক যুগের' পশ্চিমী ক্রিশ্চিয়ান ঔপনিবেশিক লুন্ঠনকারীদের কাছে পর্যন্ত ভারতবর্ষ শুধুমাত্র এক প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্যময় ভূমি ছিল না, তার সঙ্গে এই ভারতভূমি হচ্ছে 'অবিশ্বাসী' 'হিদেন' ও 'কাফের'দের ভূমি। তাদের কাছে ভারতের এই ধার্মিক ঐতিহ্যকে 'জয় করে ধ্বংস' করা 'বিশ্বাসীদের' এক 'মহান দায়িত্ব'!
এখন, এই 'ধার্মিক ভারত'কে ধ্বংস করার গোপন উপায় কি? কারণ, আজকের দিনে এটা অকল্পনীয় ও অস্বাভাবিক যে, মধ্যযুগীয় আগ্রাসন বা আধুনিক যুগের ঔপনিবেশিকতার অঙ্গ হিসাবে সরাসরি সামরিক নিয়ন্ত্রণ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতের মতো এক বিশাল দেশকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে! সেক্ষেত্রে, বিদেশি দান তো এক কার্যকরী উপায়! তাই কি একেশ্বরবাদী আব্রাহামীয় Judeo-Christian ইউরোপীয় বিশ্ববীক্ষা এবং Judeo-Islamic আরবীয় বিশ্ববীক্ষা - এই দুই পরস্পর-প্রতিযোগী ইভানজেলিকাল-ডলার ও পেট্রো-ডলার ভারতীয় ধার্মিক সভ্যতার ধারাবাহিকতাকে 'ডমিনেট' করার জন্য 'দানের মাধ্যম'কে ব্যবহার করছে?
ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি, যে বিশ্বায়িত অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক বৃদ্ধিশীল দেশের ভূমিকা নিতে তথা এক সুপার-পাওয়ার হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। এখন ভারত আর 'নরম রাষ্ট্র' (Soft State) নয়, যে সবসময় আঘাত সহ্য করে যাবে! সেই জন্য, বিদেশি দানের ক্ষেত্রে ভারত অবশ্যই তার নিজস্ব প্রয়োজন ও শর্ত সাপেক্ষে তা গ্রহণ করবে।
'শব্দ মেঘ' (Word Cloud) পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, বিদেশি দাতাসংস্থাগুলোর নামের ক্ষেত্রে চার্চ, মিশন, এইড ইত্যাদি শব্দগুলো বেশি পাওয়া যাচ্ছে; আর, গ্রহীতা এনজিওদের ক্ষেত্রে উন্নয়ন, সামাজিক, গ্রামীণ ইত্যাদি শব্দগুলো বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এখানেই প্রশ্ন: বিদেশি ক্রিশ্চিয়ান দাতাসংস্থাগুলো উন্নয়ন/মানবিক সাহায্যের জন্য দেশি ক্রিশ্চিয়ান ইভানজেলিকাল এনজিওগুলোকে বেশি পছন্দ করছে কেন? বিদেশি দান গ্রহণকারী এনজিওগুলোর মধ্যে এতো বেশি সংখ্যায় ভারত সরকারের নিয়মাবলী মেনে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের পরিক্ষিত হিসাব জমা দিয়ে লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করছে না কেন? সেক্ষেত্রে ভারত সরকার বিদেশি দানের ক্ষেত্রে এইসব এনজিওদের অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বচ্ছ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে অনুমতি দেবে কেন?
তাই, দান, ক্রিশ্চিয়ান বা ইসলামিক যাই হোক না কেন, পশ্চিম বা মধ্য-প্রাচ্য যেখান থেকেই আসুক না কেন, তা সরকারের একটি নির্দিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে সেই দানের যথাযথ নিরীক্ষণ করা দরকার। এই সাপেক্ষে এফসিআর এ্যাক্টকে এমনভাবে সংশোধন করা দরকার, যাতে শুধু এনজিও নয়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও বিদেশি দানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নিরীক্ষণ করা যায়। আর, এইসব বিদেশি-দাতারা যদি ভারতের জনসাধারণকে মানবিকতার স্বার্থে সাহায্য করতে চায়, তবে তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বা বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করুক।
ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস তথা স্বাধীনোত্তর ভারতের বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, আইনিপথে বা বেআইনি হাওয়ালার মাধ্যমে দানের ছদ্মবেশে আসতে থাকা ইভানজেলিকাল বা পেট্রো-ডলারের দাতাদের গোপন উদ্দেশ্য ও এজেন্ডা সম্বন্ধে ভারত সরকারকে আরো বেশি সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। ভারতীয় সভ্যতার লিগাসিকে স্বীকার করে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নের পরে যে ভাবে কায়েমী স্বার্থ সারা ভারত জুড়ে হিংসাত্মক ও দাঙ্গার সৃষ্টি করছে, তার পেছনে এই বিদেশি-দানের কি কোনো ভূমিকা নেই?
তথ্য সূত্র:
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Foreign_Contribution_(Regulation)_Act,_2010
Shivji, Issa G. (2007). Silence in NGO discourse: the role and future of NGOs in Africa. Oxford, UK: Fahamu. p. 84. ISBN 978-0-9545637-5-2.
@ সুজিৎ রায়
No comments:
Post a Comment