ভারতে 'জন বিস্ফোরণ': জনগোষ্ঠী, বৃদ্ধির হার ও বিতর্ক


এই বছরের স্বাধীনতা দিবসে দিল্লীর লালকেল্লা থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্যে সবথেকে বিতর্কিত বক্তব্য মনে হয় ভারতের জন বিস্ফোরণ-জনিত বক্তব্য। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সরাসরি ভিমরুলের চাকে ঢিল ছোঁড়ার মতো। কতগুলো গভীর প্রশ্ন উঠে এসেছে: ভারতে জন বিস্ফোরণ কি আদৌ ঘটেছে? যদি জন বিস্ফোরণ হয়ে থাকে, তার জন্য কোন কোন ফ্যাক্টর দায়ী? আর শেষে, এই জন বিস্ফোরণ আমরা কিভাবে মোকাবিলা করব?

প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, ভারতে সত্যিই জন বিস্ফোরণ ঘটেছে। ভারত তথা পৃথিবীর যা ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদ, তা দিয়ে এই ‘বিপুল জন ভার’কে এই ‘বিপুলা’(?) পৃথিবী আর বহন করতে পারছে না। ম্যালথুসের তত্ত্ব যেন ঘুরে-ফিরে নির্মম পরিণতির কথা স্মরণ করাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, ভারতে এই জন বিস্ফোরণের পেছনে কারণগুলো কি? ভারতীয় জনগণনা/সেনসাস, জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা- এসবের থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান যা পরিষ্কার করছে তা হল ভারতীয় জনসংখ্যার বৃদ্ধি বিভিন্ন দিকের সাপেক্ষে বিচার্য। যেমন, ধর্মীয় সম্প্রদায়গত পার্থক্য, রাজ্য তথা জেলা-ভিত্তিক পার্থক্য, গ্রাম-শহরগত পার্থক্য, আর্থিক অবস্থাগত  পার্থক্য। এমনকি এথনিক গোষ্ঠীগত পার্থক্যও বিচার্য।

বর্তমানে ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪১ শতাংশ, আর টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা প্রজননক্ষম নারীর সন্তান ধারণের হার ২.২। আসলে ভারতের ‘বেস’ পপুলেশন এতোই বেশি যে, এই কম বৃদ্ধি হারেও প্রকৃত জনসংখ্যার প্রচুর বৃদ্ধি ঘটছে। আবার, বিভিন্ন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জনবৃদ্ধির হার দেখলে বোঝা যায় সম্প্রদায়গত পার্থক্য। ২০০১-২০১১ সময়কালে দেখা যাচ্ছে, মুসলিমদের বৃদ্ধির হার ২৪.৬ শতাংশ এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে মাত্র ১৬.৮ শতাংশ। মুসলিমরা বছরে বাড়ছে ০.৮ শতাংশ হারে, আর হিন্দুরা বছরে কমছে ০.৭ শতাংশ হারে। এখানেই বিতর্কের শুরু।

ভারতের সার্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে, এটা ঘটনা। ধরা হচ্ছে, এই শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে হবে ২.১ শতাংশ, যাকে বলা হয় রিপ্লেসমেন্ট রেট বা প্রতিস্থাপন হার, যার ফলে জনসংখ্যা স্থিতাবস্থা পেয়ে একই সংখ্যায় থাকবে। আর সেই স্থিতাবস্থা সংখ্যা মোটামুটি ১৬০ কোটি। এখানেই প্রশ্ন, এই বিপুল জন-ভার আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত কি বহনযোগ্য? মাত্র ২.৪ শতাংশ ভূমি নিয়ে বিশ্বের প্রায় ১৮ শতাংশ জন-বহন করার ক্ষমতা কি ভারতের আছে? কাজেই আমেরিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রিপ্লেসমেন্ট রেট ভারতের ক্ষেত্রে খুবই প্রশ্ন-সাপেক্ষ।

এটা অনস্বীকার্য, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে দারিদ্র, শিক্ষার হার ও মান, নগরায়ন প্রক্রিয়া, জীবনযাত্রার সার্বিক মান- এসবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার সঙ্গে জনগোষ্ঠীর ধর্মীয়-সামাজিক মানসিকতা তথা নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও আইনি সুরক্ষা ব্যবস্থা জড়িত। যে জনগোষ্ঠীর নারীরা শিক্ষা, আর্থিক-সুরক্ষা ও আইনি অধিকার যতো বেশি পায়, সেই জনগোষ্ঠীর নারীর প্রজনন হার ততই কমতে থাকে। এই প্রেক্ষিতে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে দেখা প্রয়োজন।

মোটামুটি ভাবে, ষাটের দশকে পৃথিবীতে প্রথম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপায় প্রচলিত হতে শুরু করে। এইসব নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থাগুলি কিন্তু বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে চলেছে। এই সবের ব্যবহার কিন্তু শুধুমাত্র দারিদ্র, শিক্ষা ও আর্থিক অবস্থার মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা যাবে না।

আমরা জানি, জনসংখ্যার বৃদ্ধি/হ্রাস নির্ভর করে জন্ম, মৃত্যু ও প্রব্রজন অর্থাৎ মাইগ্রেশনের মিলিত প্রভাবে। আধুনিক জীবনযাত্রায় চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতিতে মৃত্যু হার অনেক কমে গেছে সকল জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই। কিন্তু সব জনগোষ্ঠীর জন্ম হার একই হারে কমে নি। ষাটের দশকের পর থেকেই এই পরিসংখ্যান বিচার করলে তা বোঝা যায়। তাই মুসলিম জনগোষ্ঠীর আপেক্ষিক জন-শতাংশ ১৯৫১ সালে ৯.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২০১১ সালে ১৪.৮ শতাংশ। এর সঙ্গে অনুপ্রবেশ/শরণার্থীদের ভারতে আগমনের কথা যদি ধরা যায়, তবে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যার  প্রকৃত ও আপেক্ষিক বৃদ্ধিও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই বৃদ্ধি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে, খুবই উল্লেখযোগ্য, যেখানে মুসলিমদের শতাংশ ১৯৫১ সালে ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১১ সালে হয়েছে ২৯ শতাংশ। সকল জনগোষ্ঠীর জন্মহার, মৃত্যুহার ও মাইগ্রেশন যদি কমবেশি একইভাবে হতো, তাহলে তো সব জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক শতাংশ ষাটের দশক থেকেই একই থাকত। তা তো হয়নি। হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্মহার ষাটের দশক থেকেই কমতে শুরু করেছে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, এই জন বিস্ফোরণ কিভাবে রোখা যাবে? এখানেই ভারত সরকার তথা অন্যান্য রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের সরকারগুলির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার। গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নকে মান্যতা দিয়েই ‘ছোট পরিবার’কে উৎসাহ-ভাতা বা সরকারি সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশে ‘স্টিক পলিসি’ যত না বেশি কার্যকরী হয়, তার থেকে অনেক বেশি কার্যকরী হয় ‘ক্যারট পলিসি’। এর সঙ্গেই মুসলিম মহিলাদের পক্ষে ‘তিন তালাক আইন’ তাদের আইনি ক্ষমতায়নের সূচনা করেছে। তার সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উপার্জনক্ষম করে তোলার মধ্যে দিয়ে ভারতের সকল নারীদের যদি ক্ষমতায়িত করা যায়, তবে হয়ত ৩৫ বা ৪০ বছরের আগেই ভারত জনসংখ্যায় স্থিতাবস্থায় পৌঁছাতে পারবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মনে হয় এটাই মূল নির্যাস।

@ সুজিৎ রায়
03.09.2019

No comments:

Post a Comment