৩৭০ ধারা: কাশ্মীরিয়ত ও ভারতীয়ত্ব


ভারতবর্ষের রাজনৈতিক জীবনধারায় ১৯৪৭ সালে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়ে ভারতের যাত্রা শুরু হয়েছিল, ২০১৯ সালের ৯ আগস্ট শুক্রবার মাননীয় রাষ্ট্রপতি শ্রী কোবিন্দের ভারতের সংসদে পাস হওয়া ‘জন্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল, ২০১৯’ সাক্ষরের মধ্যে দিয়ে আইনসঙ্গত ভাবে জম্মু ও কাশ্মীরকে সমগ্ৰ ভারতের সঙ্গে পরিপূর্ণ ভাবে অঙ্গীভূত করার মধ্যে দিয়ে আরো এক যুগান্তকারী যাত্রার সূচনা করল।

খুব সংক্ষেপে যদি এর ইতিহাস দেখা যায়, তাহলে বলতে হয় ভারতের স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ মহারাজ হরি সিংকে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারত রাষ্টে অন্তর্ভুক্তির শর্তাবলীতে কোনো ‘স্থায়ী ব্যবস্থার’ সুযোগ দেয় নি। ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা তাই কোনো অর্থেই স্থায়ী নয়, ‘অস্থায়ী ব্যবস্থায়ই’। ১৯৫৬ সালে জম্মু-কাশ্মীরের ‘গণ পরিষদ’ ৩৭০ ধারার অস্থায়িত্বকে স্বীকার করেই বিলোপ সাধিত হয়েছিল। কিন্তু সবাই ভাবতে শুরু করল যে, এই ৩৭০ ধারা আর পরিবর্তন করা যাবে না। তবে ৩৭০ ধারা যেহেতু প্রথম থেকেই সাময়িক ব্যবস্থা ছিল, তাই জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধানও সাময়িক ব্যবস্থাই ছিল। তাই, পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রেসিডেন্সিয়াল আদেশের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন আইন এই রাজ্যে লাগু হতে থাকে।  রাষ্ট্রপতির আদেশনামায় ৩৭০ ধারার ১ নং উপধারা বাতিল হয়নি, বাতিল হয়েছে ২ ও ৩ নং ধারা যেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি রাজ্যপালের সুপারিশ মোতাবেক এই উপধারাগুলিকে বাতিল বলে আদেশনামা জারি করতে পারেন। মাননীয় রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩৬৭ ধারার ব্যাখ্যামূলক অংশের  সাপেক্ষে সেই আদেশনামা জারি করেছিলেন। তবে, জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন, ২০১৯ নোটিফিকেশনের পরে ৩৭০ ধারা এখন বাতিল বলে গণ্য হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, রাজ্যপালের এই সুপারিশ কতটা সাংবিধানিক যেখানে বর্তমানে রাজ্য বিধানসভা বাতিল হয়ে গেছে। এখানেই রাজনৈতিক-সাংবিধানিক গূঢ় প্রশ্ন তথা সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরম্পরাগত অধিকারের প্রশ্ন ওঠে।

রাজনৈতিক-সাংবিধানিক প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, জম্মু-কাশ্মীর যেহেতু ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ভারতীয় নাগরিকত্ব একক, তাই ভারতীয় সংসদ, যা পুরো দেশের প্রতিনিধিত্ব করে, তার পূর্ণ অধিকার আছে যে কোনো সাময়িক ব্যবস্থাকে বাতিল করার। আর, যেখানে কোন রাজনৈতিক দল একা বা একাধিক দলের সমন্বয়ে সরকার গড়তে ব্যর্থ হয়েছে এবং বিধানসভা বাতিল হয়েছে, সেখানে জম্মু-কাশ্মীরের সব অধিবাসীর পক্ষে ওই রাজ্যের সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যপালই কনস্টিটুয়েন্ট ক্ষমতা অর্জন করেছেন এবং সেই ক্ষমতার বলেই তিনি রাষ্ট্রপতিকে ৩৭০ ধারা বিলোপের সুপারিশ করেছেন। যদিও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতির এই আদেশনামা কতদূর সংবিধান-সম্মত হয়েছে তার বিচার করবে বলেই মনে হয়। অবশ্যই এখানে ১৯৭০ সালে 'রাজন্য ভাতা বিলোপ' আইনের সাংবিধানিক বৈধতার ব্যাপারটিও সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনায় থাকবে বলে আশা করা যায়।

সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রশ্নে আসি। ভারতের সংবিধান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামাজিক দলিল, যেখানে নাগরিকদের লিঙ্গ-বর্ণ-জাতি-ধর্মমত নির্বিশেষে সকলকে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং যার মূল ভিত্তি হলো একক নাগরিকত্ব। অথচ জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্বেও সেখানে সংখ্যালঘুদের অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখদের কোন ধরনের সংরক্ষণ বা অনুসূচিত জাতি-জনজাতিদের কোন ধরনের বিশেষ অধিকার ছিল না। এমনকি, ১৯৪৭ সালের ভারত-ভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দুদের সেই রাজ্যের নাগরিকত্বের অধিকার দেওয়া হয়নি। এমন কি তথ্যের অধিকার আইন সেখানে লাগু হতে পারে নি। সাময়িক ব্যবস্থা ৩৭০ ধারাকে ঢাল করে এইসব সামাজিক বৈষম্যকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।

যে সাংস্কৃতিক পরম্পরাগত অধিকার, যাকে কাশ্মীরিয়ত বলা হয়, তার রক্ষাকবচ হিসাবে ৩৭০ ধারার কথা বলা হয়, সেই কাশ্মীরিয়ত কি শুধুই কাশ্মীরি মুসলিমদের? কাশ্মীরি হিন্দু পন্ডিত, কাশ্মীরি বৌদ্ধদের নয়? সেই কাশ্মীরিয়ত হাজার হাজার বছরের কাশ্মীরি হিন্দু সভ্যতার পরম্পরা নয়? সেই কাশ্মীরিয়ত সনাতন ভারতীয়ত্বের অংশ নয়? কাশ্মীরি শৈববাদ কি সনাতন ভারতধর্মের অংশ নয়?

এবার অন্য প্রশ্নের প্রসঙ্গে আসি। জম্মু-কাশ্মীর যেহেতু ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই ভারতের সংবিধানের অবিসংবাদী প্রয়োগই এখানে স্বাভাবিক। কারণ ভারত একটি সার্বভৌম ইউনিয়ন/একীভূত সত্তা, যা ভারতের অধিবাসীদের মিলিত সত্তা। কোন রাজ্য, সংসদ, এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এই সার্বভৌমত্বের দাবি করতে পারে না। সেই প্রেক্ষিতেই সকল অধিবাসীর অধিকার একই রকম, কিছু সাংবিধানিক ব্যতিক্রম ছাড়া।

এছাড়া, যে স্বায়ত্তশাসন বা অটোনমির কথা বলা হয়, বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা ফেডারেল স্ট্রাকচারের কথা বলা হয়, তা বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ভারতীয় সংবিধান মূলত একীভূত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে আসমুদ্রহিমাচলকে বেঁধে রেখে এক ভারতীয় জাতিত্বকে বিকাশশীল করছে। সেখানে দ্বায়িত্বহীন স্বায়ত্তশাসনের কোনো স্থান নেই।

এই প্রসঙ্গেই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে ৩৭১ ধারা ও তার বিভিন্ন উপধারার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। ৩৭১ ধারায় যে ‘বিশেষ ব্যবস্থা’র কথা বলা হয়েছে, তা মূলত কিছু ভারতবাসীর ট্রাইবাল ও এথনিক জাতিসত্তা বজায় রাখার মৌলিক অধিকারের নিয়ে। তার সঙ্গে অস্থায়ী ৩৭০ ধারাকে গুলিয়ে ফেললে অবিবেচনার কাজ হবে।

এখন, জম্মু-কাশ্মীরের অধিবাসীদের মূল ভারতীয়ত্বের সঙ্গে যুক্ত করাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। কারণ, আবহমানকালের ‘কাশ্মীরিয়ত’ ভারতের অন্যান্য খন্ডজাতিসত্তাগুলো, যেমন বাঙালি জাতিসত্তা/বাঙালিত্ব, তামিল জাতিসত্তা, মারাঠি জাতিসত্তা ইত্যাদির মতোই যে বহমান ভারতীয়ত্বের অংশ।  তাই ২০১৯ সাল 'নতুন' কাশ্মীরকে প্রকৃত অর্থেই অঙ্গীভূত করে কাশ্মীরিদের প্রকৃত কাশ্মীরিয়তে সিক্ত করার মধ্যে দিয়ে এক নতুন অধ্যায় ‘নতুন ভারতের' সূচনা করল।

@ সুজিৎ রায়
14.08.2019

1 comment:

Research Structure, Process and Behaviour

Here is the link of eBook of my book on research studies titled "Research: Structure, Process and Behaviour".  Research eBook Rega...