পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের সপ্তদশ জাতীয় নির্বাচন ২০১৯ সবে মাত্র শেষ হয়েছে। যথাসম্ভব সুষ্ঠ, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন-পর্ব সম্পন্ন করার জন্য ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদার্হ। ইভিএম ও ভিভিপ্যাটের সম্পূর্ণ সিঙ্ক্রোনাইজেশন এবং জিরো স্ট্যাটিস্টিকাল এরর প্রমাণ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের যথার্থতা। তাই ভবিষ্যতে নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। টেকনোলজির সঠিক ব্যবহারই সমাজের জন্য মঙ্গল।
এ সময়েই কিছু ইস্যুর পর্যালোচনা করা যেতে পারে। ভারতে তিন ধরনের নির্বাচনের মধ্যে জাতীয় ও রাজ্য-ভিত্তিক নির্বাচনের দায়িত্বে ভারতের নির্বাচন কমিশন, এবং স্থানীয় গ্রামীণ/নগর পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রশ্ন হলো, পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে একীকৃত ও সমন্বিত করা যায় না কি?
সার্বভৌম ভারতের গণতন্ত্রের মূলভিত্তি কি – নাগরিকবৃন্দ, রাজ্যসমূহ, সংসদ না বিচারবিভাগ? অবশ্যই নাগরিকবৃন্দ। কারণ, নাগরিকবৃন্দই এই নেশন তৈরী করেছে। সেই নাগরিকবৃন্দের প্রতিনিধিস্বরূপই স্থানিক, রাজ্য ও জাতীয় স্তরের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা এই ভারতে গড়ে উঠেছে। সেখানে স্থানীয় স্তরের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুত্ব কি কম? সাধারণ মানুষের মনে কিন্তু এই ভুল ধারণা গড়ে উঠেছে যে, রাজ্য বা জাতীয় স্তরের নির্বাচন-ব্যবস্থা যেন সুয়োরানী, আর স্থানীয় স্তরের নির্বাচন ব্যবস্থা যেন দুয়োরানী।
এসবের প্রেক্ষিতেই ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থার এক আমূল সংস্কার প্রয়োজন, যাতে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে ভারতের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূল নায়ক মনে করতে পারেন।
প্রথমত, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অবলুপ্তি। ভারতের সংবিধানের ২৪৩K এবং ২৪৩ZA অনুচ্ছেদ দুটি বিলোপ করে সেখানে স্থানীয় স্তরের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সরাসরি ভারতের নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত করে সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, জাতীয় সিলেকশন কমিশন গঠন। এই আয়োগের সদস্য হবেন তিনজন – ভারতের প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী/সবথেকে বড় বিরোধী দলের নেতা, এবং ভারতের প্রধান বিচারপতি। এই কমিশনই কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনার, সিবিআইয়ের নির্দেশক সিলেকশন করার মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, ক্যাগ, লোকপাল ইত্যাদি সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকদের মনোনয়ন করতে পারেন। এরজন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধন জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে করা যেতেই পারে।
তৃতীয়ত, স্থায়ী নির্বাচনী ক্যাডার। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের কোনো স্থায়ী ক্যাডার নেই। নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও অন্যান্য কর্মচারীদের সাময়িকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিশ্চিতভাবেই পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য সব আধিকারিকদের স্থায়ী ক্যাডার হিসাবে নিয়োগ করা অসম্ভব ও অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু অন্ততপক্ষে, উপ-নির্বাচন কমিশনার, রাজ্য নির্বাচনী আধিকারিক এবং জেলা নির্বাচনী আধিকারিকদের স্থায়ী নির্বাচনী ক্যাডার হিসাবে নিয়োগ দরকার। তাহলে নির্বাচনী প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা অনেকটাই সাধারণ মানুষ তথা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বেশি করে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। এরজন্য সংবিধান তথা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইনকে যথোপযুক্ত সংশোধন করা দরকার। চতুর্থত, জাতীয় নির্বাচনী ফান্ড/তহবিল গঠন। বর্তমানে যে হারে সরকারি ও রাজনৈতিক দলগতভাবে নির্বাচনী ব্যয় হচ্ছে, তা পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার হাতে নড়বড়ে করে তুলেছে। সব দলকে একটি লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড দিতে হলে রাষ্ট্রীয় অর্থসহায়তা বা স্টেট ফান্ডিং করা দরকার, যা ঐকমত্যের ভিত্তিতে আইনগত বিধিবদ্ধরূপে সেস বসিয়ে জাতীয় নির্বাচনী তহবিল গঠনের মাধ্যমে হতে পারে। এই তহবিল অবশ্যই জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে থাকবে।
পঞ্চমত, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি। প্রায় সব আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রেরই নিজস্ব নাগরিকপঞ্জি আছে। ভারতে তা পঞ্চাশের দশকে তৈরি করা শুরু হলেও রাজনৈতিক কারণে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ করা হয় নি। সময় এসেছে, সেই নাগরিকপঞ্জিকে সম্পূর্ণ করা এবং তার ভিত্তিতেই নির্বাচকমন্ডলী-তালিকা তৈরী করা। এই তালিকার জন্য আধার ফ্রেমওয়ার্ক তথা অন্যান্য আইনসম্মত নাগরিক চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জিই ভবিষ্যতের নির্বাচকমন্ডলীর উৎস হয়ে ওঠে। ষষ্ঠত, স্থানীয় স্তরে দলহীন নির্বাচনী-ব্যবস্থা। বর্তমানে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাবে স্থানীয় নির্বাচন হয়ে থাকে। কোনো কোনো রাজ্যে, যেমন বিহারে, দলহীন নির্বাচন হয়। সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থাই সারা দেশে চালু করা উচিৎ। কারণ, আবহমানকালের ভারতীয় জীবনধারায় স্থানীয় স্তরে দলবিহীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাই স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সংবেদনশীল প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা বজায় রেখে ছিল।
সপ্তম ও শেষতঃ, কমন পোল বা এক নির্বাচন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয়। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্য ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে করা যায় কিনা, বা করা উচিৎ কিনা? সময়, অর্থ ও সম্পদের অযথা ব্যয় ও অপব্যয় রোধ করতে একই সঙ্গে নির্বাচন করা যেতে পারে। কারণ, এখন সারা ভারতেই সবসময় কোনো না কোনো ধরনের নির্বাচন লেগেই আছে। ভারত যেন সবসময়ই ইলেকশন মোডে রয়েছে। ফলে, স্বাভাবিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা তথা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু এক দেশ, এক নির্বাচন রাজনৈতিক ভাবে হয়তো গ্রহণযোগ্য হবে না। সেই জন্য প্রস্তাব হচ্ছে, ‘এক দেশ, তিন নির্বাচন’, যেখানে জাতীয়, রাজ্য ও স্থানীয় নির্বাচনের মধ্যে দুই থেকে তিন বছরের ব্যবধান থাকতে হবে। এরজন্য ঐক্যমতের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আর, এই ব্যবস্থা ২০২৬ সালের ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরেই করা যেতে পারে।
সব মিলিয়ে, এক সার্বিক ও একীকৃত নির্বাচনী সংস্কারের মাধ্যমে আমরা ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছরের পূর্তিতে ভারতের ‘সার্বভৌম জনগণ’কে আমরাই আরো বেশি করে সার্বভৌমত্বের নির্যাস অনুভব করাতে পারি।
@ সুজিৎ রায়
29.06.2019
No comments:
Post a Comment